ফারজানা রহমান
বাঙালী নারীদের কাছে ১২ হাত লম্বা একটা কাপড় শুধুই সাধারণ বস্ত্র নয়। বাহারি নকশা আর নানা নামের শাড়ি পরার স্টাইল নারীদের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে নানাভাবে। শাড়ি ছাড়া বাঙালী নারীকে কল্পনা করা যায় না। চিরাচরিত বাঙালী জীবনের কাব্য সাহিত্যে আটপৌরে শাড়িতে ফুটে উঠে নারী চরিত্র। অন্যদিকে বাস্তব জীবনে কালের প্রবাহে পোশাকে নানা ঘরানার প্রবেশ ঘটলেও শাড়ি একেবারে হারিয়ে যায়নি তবে ভারতীয় অঞ্চলে শাড়ি পরিধানের সঠিক সময়, কাল ও এ শব্দটি কোন ভাষা থেকে আগত তা অনেকটা পরিস্কার নয়। বিভিন্ন ইতিহাস, চিত্রকলা ও সাহিত্য থেকে এর সময়কাল ও উৎস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক মতে প্রায় ৫৫০০ বছরের আগে আর্যগণ শাড়ি পরার প্রচলন শুরু করে। তবে সিন্ধু ও মেহের গড়ের মতো অনার্য সভ্যতার ধবংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত চিত্রে নারীদের পরনে শাড়ি মতো কাপড়ের ব্যবহার দেখা যায়। যা থেকে ধারণা করা হয় ভারতে অনার্যরা সেলাই জানত না বলে নারী পুরুষ সকলে অখ- বস্ত্র হিসেবে শাড়ি পরিধান করতে।
যা কালক্রমে ধুতি, উত্তলীয় শাড়ি হিসেবে নারী পুরুষের পোশাক হয়। এ প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, আদিমকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার প্রচলন ছিল না। এই অখণ্ড বস্ত্রটি পুরুষের পরিধানে থাকলে হত ‘ধুতি’, আর মেয়েদের পরিধানে থাকলে ‘শাড়ি’। নারী-পুরুষ উভয়ের শরীরের ওপরের অংশ উন্মুক্তই থাকত। তবে কখনও কখনও উচ্চবংশের নারীরা পালা-পার্বণে ওড়নাজাতীয় কাপড়ে নিজেকে ঢেকে নিত। রামচন্দ্র মজুমদারের কথায় এর সমর্থনও পাওয়া যায়, ‘তখন মেয়েরা আংটি, দুল, হার এসবের সঙ্গে পায়ের গোছা পর্যন্ত শাড়ি পরেছে।
ওপরে জড়ানো থাকত আধনা বা আধখানা।’ইতিহাসবিদদের মতে, সংস্কৃত ‘সত্তিকা’ শব্দ থেকে শাড়ি শব্দটির জন্ম। তবে অনার্য সভ্যতায় অনেক আগে থেকেই শাঢী’ শব্দটি প্রচলন পরিলক্ষিত হয় বিধায় কেউ কেউ মনে করে শাঢীই শাড়ির মূল শব্দ। শাড়ির ব্যবহারের প্রমাণ মিলে মহাভারত’য়ে। সেখানে দ্রৌপদীর যে ‘বস্ত্রহরণ’ করা হয়েছিল, সেটাও শাড়িই ছিল বলে অনুমেয়।
গুপ্ত যুগের (আনুমানিক ৩০০ থেকে ৫০০ সাল পর্যন্ত) বিখ্যাত কবি কালীদাসের ‘কুমারসম্ভব’-এ শাড়ির কথা উল্লেখ আছে। গুপ্ত আমলের ইলোরা অজন্তা গুহার প্রাচীন চিত্রাবলি বলে দেয়, খ্রিস্টাব্দ শুরুর সময়ে শাড়ির অস্তিত্ব ছিল। ইলোরা অজন্তার মতো পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলক থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, হাজার বছর আগে এই পূর্ববঙ্গে শাড়ির প্রচলন ছিল। যদিও সে সময়ের শাড়ি পরার স্টাইল এখনকার মতো ছিল না। আবার চৌদ্দ শতকের কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন, ‘নীল শাড়ি মোহনকারী/উছলিতে দেখি পাশ।’ তখনকার কবিরা এভাবে শাড়ির প্রকাশে ভিন্নতা এনেছে শাড়ির রঙয়ের বয়ান দিয়ে।
সময়ের ধারাবাহিকতাতে ভারত বর্ষে মুসলমানদের আগমন আর মোঘল আমলে শাড়ি আভিজাত্যের ছোঁয়া পায়। এর সাথে দেখা যায়, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের নারীরা শাড়িকেই নিজেদের পরিধানের প্রধান বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে। যা পরবর্তীতে পরিধানে নানা স্টাইল ছিল অঞ্চল ভেদে। আধুনিক ভাবে শাড়ি পরিধানে নতুনত্বের প্রকাশ ঘটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকো পরিবারে। ঠাকুরবাড়ির বধূ জ্ঞানদানন্দিনী পার্সি কায়দায় কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার স্টাইল আরম্ভ করেন। যা এখন সকল নারীদের শাড়ির পরার সচারাচর পদ্ধতি।
বাঙালী উৎসব ভিত্তিক শাড়ি আধুনিক বাঙালী নারীদের কাছে আর্কষণীয় বিষয়। ঐতিহ্যবাহী মসলিন, জামদানী, বেনারসি, তাঁতের শাড়ি বাঙালী নারীদের কাছে সব সময় আকর্ষণীয়। যেমন চিরাচরিত বাঙালী নারীর কাছে বিয়ের সাজের স্বপ্ন মানেই লাল রঙয়ের বেনারসি। আবার বৈশাখী উৎসবে লাল পাড়ে সাদা শাড়ি, বসন্তে হলুদ শাড়ি। অন্যদিকে দেশের নানা দিবসের আবহ তুলে ধরে শাড়ির রং। ২১ ফেব্রুয়ারিতে কালো পাড়ে সাদা শাড়ি, স্বাধীনতা আর বিজয় দিবসে লাল সবুজ রঙের শাড়ি। সুতরাং বাঙালী নারীর শাড়ির নান্দনিক উপস্থাপনের মর্মার্থ অত্যন্ত গভীরে।
সময়ের সাথে সাথে ব্যস্ত জীবনে সহজ সাবলীল পোশাক হিসাবে সালোয়ার কামিজ, ওয়েস্টার্ন ড্রেসে নারীদের আগ্রহ এখন অনেক বেশি। কিন্তু তাই বলে শাড়িপ্রীতি নাই তা কিন্তু নয়। উৎসব আয়োজনে শাড়িরই প্রাধান্য থাকে বেশি।
আবার আধুনিক কালে শাড়িতে এসেছে অনেক বৈচিত্র্যতা। বিশেষ করে ফ্যাশন হাউসগুলো ১২ হাত শাড়িতে ফুটিয়ে তোলে তাদের কাবিক্য মনের ভাবনা। দীর্ঘ শাড়িটি ডিজাইনারদের কাছে একটা বিশাল ক্যানভাস। আর তাতে যে শিল্পকর্মটি করা হয় তা আরো বেশি জীবন্ত হয়ে উঠে। যখন নারী পরে শাড়িটি। তাই জরি চুমকি পাথর আর হাতের কাজ, পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি বাংলার তাঁতীরা এ শাড়িতে আনে বাহারি ডিজাইন। যা বাঙালী নারী সাজে আনা ভিন্ন মাত্রা।
তাই শৈশবে শাড়ি পরিয়ে পুতুল খেলার ছলে বেড়ে ওঠা বাঙালী নারী আর শাড়িতে বিচ্ছেদ আসবে তেমনটা ভাবা ভুল। আর শাড়ি এমন একটি পোশাক যা বাঙালী নারীকে নিজস্ব রূপ দেয়।