নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকটে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত

WhatsApp-Image-2025-05-06-at-4.09.56-AM.jpeg

‎‎জহিরুল হক জহির ।।

‎‎নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকট সহ বিভিন্ন কারণে চিকিৎসা সেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক ও সহায়ক কর্মীদের সংকট থাকায় হাসপাতালে আসা রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে ৫৭টি পদ শূন্য রয়েছে। ১৪ জন চিকিৎসক প্রয়োজন, মাত্র ৩ জন চিকিৎসক দিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

‎‎প্রতিদিন প্রায় ৫০০ রোগী আউটডোরে সেবা নিতে আসেন, এবং ৮০-৯০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেয়। তবে চিকিৎসক ও সেবাকর্মী সংকটে রোগীদের সেবা প্রদান কঠিন হয়ে পড়েছে সেবাকর্মীদের পক্ষে।

‎‎এছাড়া ইমারজেন্সি বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ৫০ জনেরও বেশি রোগী সেবা পেতে আসলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় রোগীরা অসহনীয় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তাছাড়া এ্যম্বুলেন্স এর চালক না থাকায় এ্যম্বুলেন্স সেবাও পায় না রোগীরা! জেনারেটর এর তেলের বরাদ্দ না থাকায় বিদুৎ চলে গেলে জেনারেটর চলে না ! এই গরমে চরম কস্টের মধ্যে থাকতে হয় রোগীদের।

‎‎‎এখানে ১ম, ২য়, ৩য় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদেও শূন্যতা রয়েছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মী, আয়া, মালী/সুইপার পদ শূন্য থাকায় হাসপাতালের পরিবেশ নোংরা হয়ে পড়েছে। এতে হাসপাতালে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে এমনই দৃশ্য দেখা গেছে ।

‎‎স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রয়েছে আধুনিক ভবন। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক ও জনবল সংকট নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে খুড়িয়ে-খুড়িয়ে চলছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম। উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ২০০৬ সালে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করা হয়।

‎‎পরবর্তীতে রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে ২০১৭ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হিসেবে উন্নীতকরণ করা হলেও সেবার মান এখনো সন্তোষজনক নয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী রোগীদের।

‎‎অথচ প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের চিকিৎসার ভরসা এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কারণ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন উপজেলার মানুষও এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অত্র এলাকার একমাত্র বড় সেবা প্রতিষ্ঠান। এখানে উন্নত চিকিৎসার অভাবে মানুষকে মাইজদী, বসুরহাট, ফেনী, চট্রগ্রাম ও ঢাকায় যেতে হয়। এতে দরিদ্র রোগীরা সবচেয়ে বেশী বিড়ম্বনায় পড়েন।

‎‎হাজারো সংকট আর অব্যবস্থাপনা থাকলেও হাসপাতালটির স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে যেনো কারও মাথা ব্যথা নেই ! এমনই অভিযোগ এই উপজেলার মানুষের।

‎‎‎‎হাসপাতালের রোগী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে এ হাসপাতালের কার্যক্রম।সরেজমিনে দেখা যায়, নোয়াখালীর অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর মতোই এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পুরুষ রোগী থেকে নারী রোগীর সংখ্যা তুলনা মূলক বেশি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন অনেক মুমূর্ষু রোগী। অনেকে সিট না পেয়ে মেঝেতে শুয়ে আছেন।

‎‎রোগী অনুপাতে চিকিৎসক ও সিট স্বল্পতা, ওষুধ সংকট ও খাবার সরবরাহে তেমন সন্তোষজনক সেবা পাচ্ছেন না চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। এছাড়াও আয়া, মালি/সুইপার না থাকায় ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাসপাতালের মেঝেতে।

‎রোগীদের অভিযোগ, রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি তেমন না থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরের ক্লিনিকে তাদেরকে যেতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রোগীদের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।

‎‎জানা গেছে, চিকিৎসক সহ নিম্নবর্ণিত জনবল সংকটের মধ্যেও চালানো হচ্ছে হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম। উন্নত স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য সামান্য কিছু যন্ত্রপাতি ও ওষুধ থাকলেও সেসবের সুবিধা তেমন পান না রোগীরা। নেই দক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ল্যাব ও টেকনিশিয়ান। অথচ এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন শত শত অসুস্থ রোগী।

‎‎খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে ডাক্তার প্রয়োজন ১৪জন। আছেন মাত্র ৩জন। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদ সহ আরও কয়েকটি পদ সৃস্টিই হয়নি। নেই স্টোর কিপার, এ্যাম্বুলেন্স আছে কিন্তু ড্রাইভার নেই, ফার্মাসিস্ট নেই, নেই কোন পরিচন্নতা কর্মী কিংবা সুইপার,অফিস সহায়ক প্রয়োজন ৩জন,আছে মাত্র ১জন।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা মোট ৬০টি, কর্মরত পদে রয়েছেন ৪৪ জন, শুন্য পদের সংখ্যা ১৬টি, আরো দরকার ৫৭জন।

‎‎চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার নরোত্তমপুর ইউনিয়নের মো. জাফর আহমদ (৪০) বলেন, জ্বর, পেটে ব্যথা ও বুকে ব্যথা নিয়ে অনেকদিন ধরে ভুগছি। এখানে আসার পর ডাক্তার কয়েকটি টেস্ট দিল। সেই টেস্টের প্রায় সবগুলোই বাইরে থেকে করে নিয়ে আসতে হবে। যদি বাহিরে থেকেই করে নিয়ে আসতে হয় তাহলে এখানে এসে কী লাভ হলো?

‎‎বাটইয়া ইউনিয়নের রোজী আক্তার (৩২) বলেন, আমার এক বছরের মেয়েকে ভর্তি করিয়েছি। বেড না পাওয়ায় বারান্দার মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি। অপরিস্কার মেঝেতে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেকগুলো ওষুধ লিখে দিয়েছে ডাক্তার। লিখে দেওয়া সেই ওষুধগুলো এখানে না পেয়ে বেশি দামে বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।

‎‎মেয়ের ঠান্ডাজনিত রোগের চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়নের আব্দুল জলিল (৪২) বলেন, হাসপাতালে আমি দুইদিন থেকে রয়েছি। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের খাবারের মান তেমন বেশি সুবিধাজনক নয়। সেই সাথে প্রয়োজনীয় তেমন ওষুধও পাওয়া যায় না। দুই একটি ওষুধ পাওয়া গেলেও বাকি ওষুধ প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বাইরের ফার্মেসি থেকে নিয়ে এসে মেয়েকে খাওয়াতে হচ্ছে। হাসপাতালের পরিবেশ তেমন ভালো নয়। একজন রোগীর পর্যাপ্ত সেবা এখানে পাওয়া যায় না।

‎‎স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন কর্মচারী ও স্থানীয়রা জানায়, বর্তমানে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবেশ ভালো নয়, অপরিস্কার সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধও তেমন পাওয়া যায় না। এখানে ভর্তি হওয়া রোগীরা রাতে যদি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে দেখার মতো ডাক্তার পাওয়া যায় না।

‎‎এখানে এক্সরে মেশিন, ইসিজি, অপারেশন থিয়েটার সহ সব ধরনের আংশিক ব্যবস্থা থাকলেও টেকনিশিয়ান ও দক্ষ জনবলের অভাবে এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

‎‎তাই সাধারণ কিছু চেকআপও বাইরে থেকে করে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এছাড়া জরুরী বিভাগ, অভ্যন্তরীণ চিকিৎসা প্রদান, আউটডোর ও অ্যাম্বুলেন্স সেবায় নেই লোকবল। এক প্রকার নাজুক অবস্থা এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের।

‎‎একাধিক রোগী অভিযোগ করে বলেছেন, শৌচাগার গুলো ব্যবহার অনুপযোগী। এর পাশাপাশি রয়েছে সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি। দ্রুত জনবল নিয়োগ না হলে স্বাস্থ্যসেবার মান আরও অবনতির দিকে যাবে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। অনেক সময় রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে নার্স ও স্টাফদের সাথে তর্ক-বিতর্ক হয় এসব সমস্যা নিয়ে।

‎‎আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আর এম ও) ডাঃ ফজলুল হক বাকের বলেন, চিকিৎসক সহ জনবল সংকটে চলছে আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিয়মিত কার্যক্রম। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন শত শত রোগী। রোগী অনুপাতে চিকিৎসক ও জনবল স্বল্পতা রয়েছে। বর্তমানে অন্যতম সমস্যা হলো সুইপার/মালি সংকট। যার কারনে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারে ভিষণ সমস্যা হচ্ছে। এ সমস্যাগুলো সমাধান হলে স্বাস্থ্য সেবার মান আরো ভালো হবে।

‎‎কবিরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.শ্যামল কুমার দেবনাথ বলেন, লোকবল সঙ্কটেও আন্তরিকতার সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে চিকিৎসক ও জনবল সংকটের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে।

‎ভালো সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কর্তৃপক্ষের ও চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। জনবলের চাহিদা সহ আরো বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করি সাময়িক সমস্যাগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান হবে এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে।

‎‎এ বিষয়ে নোয়াখালীর সিভিল সার্জন ডাঃ মরিয়ম সিমি বলেন, এখানে ১ম, ২য়, ৩য় ও ‎চতুর্থ শ্রেণির পদেও শূন্যতা রয়েছে। পুরো নোয়াখালীতে ৬০শতাংশ জনবল সংকট রয়েছে। অনেক জায়গা লোকবল সংকটের কারণে ওটি পর্যন্ত হয়না। কবিরহাটে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশাকরি সরকারের নতুন নিয়োগে কবিরহাটের জনবল শূন্যতা পূরণ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top