লক্ষ্মীপুর থেকে রিয়াজ মাহমুদ বিনু ।।
নদী সংলগ্ন টাংকির বাজারের উত্তর দিকে প্রায় ১২ কি. মি বেড়িবাঁধ। সবুজ বৃক্ষে ঘেরা বাঁধটি দিয়ে হাটা দিলে যে কারো মন ভরে যাবে। বেড়ির কোলে নদী থেকে আঁছড়ে পড়া ঢেউ এর অপরূপ দৃশ্যের সমারোহ। কিন্তু প্রায় ৫ শ’ মিটার দূরত্বে এ অপরুপ দৃশ্যের ভয়ঙ্কর রুপ মুহুর্তে যে কারো মন খারাপ করে দিতে পারে। কারণ উত্তাল নদীর প্রতিটা ঢেউ গিলে খাচ্ছে অপরূপ সৌন্দয্যে ভরা বেড়িবাঁধটি এবং সবুজ বৃক্ষ।
মেঘনা নদীর উপকূলীয় এলাকা বয়ারচর টাংকির ঘাট। প্রায় ১০ হাজার জনসংখ্যার বসবাসের স্থানটি নোয়াখালীর হাতিয়ার হরণী ও লক্ষ্মীপুরের রামগতির চরগাজী সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। যদিও সেখানে সীমানা জটিলতা নিয়ে বিরোধ চলছে। ফলে অমীমাংসিত বয়ারচরটি কোন এলাকার তা এখনো নিরুপন না হলেও ওই এলাকায় প্রায় ৯০ শতাংশ লোক রামগতির ভোটার।
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্যগণ ওই বাসিন্দারের কাছে বাঁধ সংলগ্ন বয়ারচরের বাসিন্দাদের দাবি ছিলো বাঁধটির টেকসই মেরামত করার জন্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঐ এলাকার বাসিন্দাদের নিকট বর্তমান সংসদ সদস্যও দাবি অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হলেও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোন কার্যকর প্রদক্ষেপ দেখা মেলেনি। ফলে ক্ষোভ বিরাজ করছে তাদের মধ্যে।
ভাঙন কবলিত বাসিন্দারের অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্য গত নির্বাচনের আগে বয়ারচরের টাংকিবাজারে এসে এলাকাবাসীকে নদী ভাঙন রোধের আশ্বাস দেন। নির্বাচনের পর প্রায় দেড় বছর ধরে সর্বনাশী মেঘনা ভাঙন অব্যাহত রাখলেও কথা রাখেননি সাংসদ। এরই মধ্যে ভিটেমাটি হারিয়েছেন অনেকে।
জানা গেছে, চর উন্নয়ন বসতি স্থাপন প্রকল্প (সিডিএসপি) এর আওতায় নেদারল্যান্ড সরকারের অর্থায়নে প্রায় ১০ বছর আগে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর সীমান্ত এলাকা বয়ারচরে নির্মাণ করা হয় এ বেড়িবাঁধটি। গত ৫ বছর আগে মেঘনা নদী বেড়ি থেকে প্রায় তিন কি. মি. দূরত্বে ছিলো। কিন্তু দিনের পর দিন ভিটেমাটি এবং ফসলি জমি গিলে খেয়েছে করালগ্রাসী মেঘনা। আর এখন বেড়িবাধঁটি মেঘনার পেটে যেতে শুরু করেছে।
বয়ারচরের বাসিন্দা বৃদ্ধ নুরুল ইসলামের পৈত্রিক বাড়ি ছিলো বাঁধ থেকে প্রায় দেড় কি. মি. দূরে। চার বছর আগে তার ওই পৈত্রিক বাড়িটি কেড়ে নিয়েছে মেঘনা। সাথে আড়াই একর ফসলি জমিও। ভিটেমাটি হারিয়ে ১০ নং টাংকি সমাজের বেড়িবাঁধের পাশে এসে স্ব-পরিবারে আশ্রয় নেন তিনি। আশ্রয়স্থলের দখলটি তাকে কিনতে হয়েছে সাত হাজার টাকার বিনিময়ে। কিন্তু মেঘনার নজর এখন সেই আশ্রয়স্থলের দিকে। মেঘনা চলে এসেছে বসত ঘরের দুই ফুটের মধ্যে। করেয়কদিন মধ্যে মেঘনার পেটে যাবে তার বসতি। ছেলে মেয়েসহ পরিবারের ১৫ সদস্য নিয়ে কোথায় যাবেন সে চিন্তায় দিশেহারা তিনি।
পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা কৃষক আবু তাহের ও তার দুই পুত্রের তিনটি ঘর। দুই সপ্তাহ আগে ভিটে থেকে ঘরটি ভেঙ্গে ফেলেছেন তিনি। কয়েকদিনের মধ্যে তার দুই ছেলেও ঘরও ভেঙ্গ ফেলতে হবে। কারণ মেঘনা তাদের চোখ রাঙ্গানি দিচ্ছে।
তিনি বলেন, কয়েক বছর থেকে মেঘনার ভাঙন অব্যাহত ছিলো। এখন বেড়িবাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে। বাঁধের বিপরীত পাশেই আমাদের বাড়ি। সাথে ফসলি জমিও আছে। যে কোন সময় নদীতে তলিয়ে যাবে সহায়-সম্বল। তিনি বলেন, ঘুর্ণিঝড় আম্পানের পর থেকেই ভাঙন পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বাঁধের পাশের বাসিন্দা ছালেহা বেগমের স্বামীর বাড়ি ছিলো রামগতির চরগাসিয়া এলাকায়। তিন বছর আগে ভিটেমাটি হারা হন তিনি। আশ্রয় নেন কামাল বাজার এলাকায়। এক বছরের ব্যবধানে সেই আশ্রয়টিও কেড়ে নেয় মেঘনা। চলে আসেন বয়ারচরে। দুই বছরের মাথায় আবারও ভাঙনের মুখে পড়েছেন। স্বামী ও চার সন্তান এই জেলে পরিবারের পরবর্তী যাত্রা কোথায় হবে তা অনিশ্চিত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাঁধটি একপাশে মেঘনা নদী, অন্যপাশে মানুষের বসবাস। এর দুই পাশে বন বিভাগের পক্ষ থেকে গাছ লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনি তৈরী করা হয়েছে। নদীতে জোয়ারের সময় ভারী ঢেউ বাঁধে এসে আঁছড়ে পড়তে দেখা গেছে। এত নদী সংলগ্ন বাঁধের পাশের গাছগুলো ইতোমধ্যে নদীতে ভেঙে পড়েছে। বাঁধের বেশিরভাগ অংশ নদীতে তলিয়ে গেছে। বাঁধ সংলগ্ন বাসিন্দারের অধিকাংশই জেলে এবং কৃষক। কোনরকম দিন পার করছেন তারা। এরই মধ্যে বাসিন্দাদের মধ্যে ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে। কোন জনপ্রতিনিধি তাদের দিকে নজর না দেওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে তাদের মধ্যে।
কয়েকজন এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বতমান সংসদ সদস্য মেজর (অব:) আবদুল মান্নান ভোট চাইতে টাংকি বাজারে আসেন। এলাকাবাসী নদী ভাঙনরোধের প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপের দাবি জানান তার প্রতি। ভোট নেওয়ার আগে তিনি সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন বাসিন্দারের। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এ এলাকায় তার আর দেখা নেই। হয়তো ভূলে গেছেন তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি। তারা বলেন, এলাকার কোন উন্নয়নে সংসদ সদস্যের ভূমিকা ছিলো না। সরকারী বরাদ্ধ বা হতদরিদ্রের জন্য আসা বরাদ্ধ কোথায় আসে, কিভাবে আসে বা কারা পায়, সেটি তারা জানেনও না। সরকারের বিনামূল্যে দেওয়া কোন ঘর পাননি এ এলাকার অসহায় বাসিন্দারা। করোনাকালেও অসহায়দের কোন খবর রাখেননি তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আমাদের সংসদ সদস্য আওয়ামীলীগের দলীয় সাংসদ না হওয়ায় উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারের উন্নয়নে কোন কাজ করেননি। দলীয় সংসদ সদস্য হলে হয়তো এ এলাকার মানুষের খবর রাখতেন।
স্থানীয় সংবাদকর্মী আবদুল কাইয়ুম বলেন, পুরো বায়ারচর এবং এর আশপাশে প্রায় তিন লাখ লোকের বসবাস। বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব পড়বে এ সকল লোকের উপর। কেউ ভিটে মাটি হারা হবে, আবার কারো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাঁধটি ভেঙে গেলে জোয়ারের পানি ঢুকে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হবে।
তিনি বলেন, বায়রচরের বাসিন্দারা দুই জেলার বিতর্কিত সীমান্তে হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন তাদের দিকে নজর দিচ্ছেনা। ফলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধ মেরামতের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এতে সবুজ বেষ্টনি ঘেরা বয়ারচর রক্ষা বাঁধটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে ভিটেমাটি হারাচ্ছে ওই এলাকার বাসিন্দারা। ভাঙন আতঙ্কে আছে কয়েকশ পরিবার।
তিনি আরও বলেন, বাঁধটি মেরামতের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এ এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ ভোটার রামগতির। টেকসই প্রকল্পের মাধ্যমে সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধটি মেরামতের জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং স্থানীয় সাংসদ মেজর (অব:) আবদুল মান্নানের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।