বামজোটে অনিশ্চয়তা : কর্মসূচিতে স্থবিরতা

Bamdal.jpg

বাম গণতান্ত্রিক জোটের ২০১৮ সালের ১৮ জুলাই সভার ছবি

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রতিষ্ঠার ২ বছর পার করার পর কৌশলগত অবস্থান নিয়ে নড়েচড়ে উঠেছে ৮টি দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট। করোনা মহামারিকালে সরকারের বিদ্যমান নীতি ও অবস্থান নিয়ে ঐক্যমত থাকলেও ‘অ্যাকশন পদ্ধতি’ ও কর্মসূচি নির্ধারণকে কেন্দ্র করে জোটের ঐক্য অনিশ্চয়তায় পড়েছে। জোটের কোনও কোনও শরিক দলের নেতা মনে করেন, যে পদ্ধতিতে জোট টিকিয়ে রাখা হয়েছে, এর রাজনৈতিক কোনও তাৎপর্য নেই। ইতোমধ্যে জোটের মধ্যে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে এবং একটি পক্ষ বামজোটের বিদ্যমান কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। গত কয়েকদিনে জোটের বাম নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব বিষয় উঠে আসে।

আলাপকালে জোটের সাবেক একাধিক সমন্বয়ক জানিয়েছেন, জোট ও জোটের শরিক দলগুলোর সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও কার্যকর কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেনি বাম জোট। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর গত ১৩ এপ্রিল ‘সর্বদলীয় পরামর্শ সভা’ থেকে মহামারি মোকাবিলায় ‘সমন্বিত উদ্যোগ’ এবং ‘জাতীয় দুর্যোগ’ গ্রহণের দাবি জানায় বামজোট। যদিও এরপর রাজনৈতিকভাবে সমন্বিত কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি জোটের শরিক নেতারা।

এছাড়াও জোটের একাধিক সিনিয়র নেতা  জানান, ১৩ এপ্রিল ‘সর্বদলীয় পরামর্শ সভা’র পর যে দলগুলো সভায় অংশগ্রহণ করে, তাদের সমন্বয়ে একটি সর্বদলীয় সমাধান প্রস্তাব তৈরি করে সরকারের কাছে পাঠানোর বিষয়ে আলোচনায় হয়। ওই আলোচনাও জোটের বড় একাধিক দলের ভেটোর কারণে বন্ধ হয়ে যায়। জোটের কোনও-কোনও নেতার ভাষ্য, করোনাভাইরাসের মহামারিকালে বামপন্থী দলগুলোর সামনে দেশের মানুষের কাছে নতুন একটি পরিচয় সামনে আনার সুযোগ ছিল। বিশেষ করে, জোটগতভাবে অনলাইন সভার বাইরে সম্মিলিতভাবে কার্যকর কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বামজোট।

বামজোটের প্রথম সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে জোটগতভাবে আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম এরপর এটাকে অব্যাহত রাখতে চেয়েছি। সরকারি দল যদি রেসপন্ড নাও করে, বাকি দলগুলোর যারা যুক্ত ছিলাম তারা মিলিয়ে উদ্যোগটাকে অব্যাহত রাখা। এমনকি সরকারি দলের জন্য স্পেসটাকে ওপেন রাখা। এই প্রশ্নে জোটের বড় দলসহ অনেক শরিকরা সবাই একমত হতে পারিনি। বিশেষত ভবিষ্যতে এই উদ্যোগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় কিনা-এই উৎকণ্ঠা থেকে উদ্যোগটিকে এগিয়ে নিতে চায়নি কোনও কোনও দল।’
সাইফুল হক আরও বলেন, ‘জোটের কর্মসূচি অ্যাপারেন্টলি আছে, অনলাইনে আছে, কয়েকদিন আগে বিক্ষোভ হয়েছে কিন্তু এই করোনাকালে জোট যে ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল সে অনুযায়ী কার্যকর কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি জোট। জোটের শরিকরা নিজেরা দলীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বেশি। আমরা যদি ব্যর্থ হতাম তবুও এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর একটি অংশের সঙ্গে বামপন্থীদের মনস্তাত্ত্বিক যে দূরত্ব ছিল, জোটের জন্য সুযোগ ছিল তা কাটিয়ে উঠার। কোনও-কোনও জোটগত উদ্যোগের চেয়ে দলগত উদ্যোগ নিতেই আগ্রহ বেশি।’
সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা প্রস্তাব করেছি, জোটের অন্য আরও শরিকেরা প্রস্তাব করেছে। এটাও বলা হয়নি, যে বিএনপিকে যুক্ত হতেই হবে। কিন্তু একটা সেন্ট্রাল মনিটরিং টিম করা, ফরমাল একটা বোঝাপড়া তৈরি করা। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমীকরণ কী দাঁড়ায়-তা নিয়ে কারও কারও ধারণাগত অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে।’

২০১৮ সালের ১৮ জুলাই ৮ দলের সমন্বয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক বাম জোটের দলগুলো হচ্ছে—বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়নি বামজোট। যদিও ওই নির্বাচনে সিপিবি প্রার্থী দেয়। এরপর গত ১৩ এপ্রিল করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় ‘সমন্বিত উদ্যোগ’ এবং ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণার দাবি জানায় বাম গণতান্ত্রিক জোট। এই পরামর্শ সভায় সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ছাড়া বিএনপি, সিপিবি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বামজোটসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা স্কাইপের মাধ্যমে এই পরামর্শ সভায় অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমসহ অনেক নেতা বক্তব্য রাখেন।

বামজোটের একাধিক নেতা বলেছেন, ‘সরকারকে সহযোগিতা করতেই আমরা একটি সর্বদলীয় মনিটরিং সেল গঠন, জেলায়-জেলায় ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা মনিটরিং করার জন্য একটি সর্বদলীয় উদ্যোগের বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম ১৩ এপ্রিলের মতো আবারও একটি সর্বদলীয় উদ্যোগ গ্রহণ করি। সেখান থেকেই একটি দাবিনামা জানাই সরকারের কাছে। বিশেষ করে, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা তো সরকারের কাজ, সেক্ষেত্রে সেন্ট্রাল মনিটরিং টিম গঠন করে দেশের কোথায়-কোথায় সমস্যা হচ্ছে, তা নিয়মিত তুলে ধরে সমাধান করার। কিন্তু জোটের অভ্যন্তরে ভিন্নমতের কারণে এই সিদ্ধান্ত সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। ওই উদ্যোগ এখন শ্লথ হয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সাবেক একজন সমন্বয়ক বলেন, ‘বামজোটের দৃশ্যমান রাজনৈতিক অবস্থান এক আছে। কিন্তু এই কম্পোজিশন দিয়ে মুভমেন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষত করোনাভাইরাস নিয়ে সরকারের অবস্থান ও ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিগত টানাপোড়েন আছে, এটি সত্যি। যে কারণে করোনা মহামারির সময়ে যে ধরনের অলআউট রাজনৈতিক তৎপরতার সম্ভাবনা ছিল, বামজোটের বিদ্যমান কাঠামোর ভেতর থেকে নতুন কোনও সম্ভাবনা আর নেই।’ তবে জোটের অভ্যন্তরে সমস্যার বিষয়টি সঠিক নয়, বলে জানান জোটের শরিক সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি  বলেন, ‘আমরা সরকারকে বলেছিলাম সবার সঙ্গে পরামর্শ করে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করতে। কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি।’

জোটের রাজনৈতিক পলিসি নির্ধারণ নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং জোটের ঐক্যে সমস্যা চলছে—এমন প্রসঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘না, আমাদের মধ্যে এরকম কিছু হচ্ছে না। আমরা তো একসঙ্গে প্রোগ্রাম করছি। স্টেটম্যান্ট দিচ্ছি। দুইদিন আগেও তো প্রোগ্রাম করেছি। এটা সরকারি পক্ষ হতে পারে। যারা চায় না শক্তিশালীভাবে বিকল্প শক্তি গড়ে উঠুক। সরকারও হতে পারে, বিএনপিও হতে পারে। আর মৌলবাদীরা তো আছেই। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির ভেতরে সবচেয়ে সক্রিয় ফোর্স হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থীগুলো। এটা আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারি। মানুষের জীবনের স্বার্থে সাধ্যমত স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে।’
এ বিষয়ে বামজোটের শরিক গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘এই মুহূর্তে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ, শ্রমজীবীসহ মধ্যবিত্ত পর্যন্ত যে সংকটের মধ্যে আছে, এই সংকট নিরসনে সরকার উদাসীন ও ব্যর্থ। সরকার তাদেরকেই খুশি রাখছে যারা তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে। এখন জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। মানুষের চিকিৎসা, জীবন-জীবিকা নিয়ে ন্যুনতম আন্দোলন গড়ে তোলার সময়। দরকার ঐক্যবদ্ধ তৎপরতা। আমরা সে জন্য কাজ করছি।’

জোটের সাবেক সমন্বয়ক ও সিপিবির নেতা আবদুল্লাহ আল কাফি রতন বলেন, ‘আমি তো এমন কোনও প্রবলেমের কথা শুনিনি। আমরা ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছি। দেশের জেলায়-জেলায় সিভিল সার্জন অফিসের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। মহামারির কারণে সিনিয়র নেতারা কেউ-কেউ বাসায় আছেন। তরুণ নেতাদের অনেকেই নিয়মিত মাঠের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। সিনিয়র ও বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা বাসায় থেকেই কাজ করছেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জোটের সমন্বয়ক, বাসদ (জামান) কেন্দ্রীয় নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে কোনও বিরোধ সৃষ্টি হয়নি বামজোটে। এটা তো জোট, জোটে অনেকগুলো শরিক দল রয়েছে। কেউ মনে করছে, এখনই কিছু করা দরকার, কেউ বলছেন, আরেকটা করা উচিৎ। একটা দলের মধ্যেও তো ভিন্নমত আছে। এতে করে দলের বা জোটের অবস্থানের পরিবর্তন হয় না। এখন করোনা মহামারি, সংক্রমণ বাড়ছে, আতংক বাড়ছে। এরপরও আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যখাতের, অর্থনীতি নিয়ে অনলাইন সভা করেছি। সবকিছু তো বললেই হয় না, মাঠের আন্দোলনে থাকতে হয়। আমরা অল্প মানুষ নিয়ে চেষ্টা করতেছি। আলাপ-আলোচনা করে তো সব সময় করা যায় না। মুভমেন্টই ঠিক করবে, কোন জায়গায় যেতে হবে। এগুলো কোনও মেজর সমস্যা নয়।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top