আগে চর দখলে, এখন রাজপথ দখলে লাঠি

01.jpg

রাজপথে বিএনপির লাঠি মিছিল।

মকছুদের রহমান মানিক ।।

রাজনীতিতে লাঠি উত্তাপ বাড়ছে।  আগে রাজনীতিতে মুখোমখি সংঘর্ষে লাঠি ব্যবহার হতো। লাঠির শক্তিতে এক পক্ষ রাজনীতির মাঠ বা রাজপথ দখলে নিতো। তার আগেও লাঠি ব্যবহার হতো চরের জমি দখলে। যারা নায়ক ফারুকের লাঠিয়াল দেখেছেন, তারা দেখেছেন। আর যাদের বসবাস চর এলাকার তারা লাঠির দৌরাত্ম্য দেখেই বড় হয়েছেন।

রাজনীতিতে প্রথম লাঠির ব্যবহার নিয়ে আসে বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল জাসদ। তাদের দলীয় প্রতীক ছিলো মশাল। লাঠির বা বাঁশের মাথায় ছোট কেন দিয়ে মশাল জ্বালিয়ে রাজপথে নামতো জাসদ। এক কাজে দুই কাজ সরাতো জাসদ। মিছিলও হলো, আবার প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকানো যেতো।

২০০৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর খালেদার দলীয় কেয়ারটেকার সরকাররের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ রাজপথে লগি বৈঠা নিয়ে এসেছিলো। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা। নৌকা চালাতে লগি বা বৈঠার প্রয়োজন পড়ে। তাই সেদিনও  একদলীয় তত্ত্বাবধায়ক ঠেকাতে লগি বৈঠার ব্যবহার আওয়ামী লীগকে তাদের লক্ষে পৌছে দিয়েছিলো।

তবে সেই সময়ে আমাদের দেশে সোস্যাল মিডিয়ার এতোটা দাপট ছিলো না। বর্তমান আধুনিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এতোটাই অগ্রগতি হয়েছে যে প্রতি সেকেন্ডে মিনিটে  আপগ্রেড হচ্ছে সংবাদ মাধ্যম বা সোস্যাল মিডিয়া। ফলে প্রযুক্তি বিশ্ব এবং জাতির কাছে আমাদের সকল অপরাথ তুলে ধরছে।

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে টিকতে পারছিলো না। বার বারই রাজপথে পুলিশ তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে যাচ্ছে। বিএনপির নেতারা বার বার পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদ করে আসছিলো। কিন্তু সরকার তাদের আবদার কানে তোলেন নি। বিএনপি না পারছে রাজপথ দখলে নিতে, না পারছে সরকারকে বাধ্য করতে।

তাই বিএনপি রাজপথে টিকতে থাকতে হাতে লাঠি তুলে নিয়েছে।  বেশ কিছুদিন লাঠির জোরে রাজধানীতে মাঠ ছাড়ছে না বিএনপি । বিএনপি  শতশত নেতাকর্মী প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে  লাঠি নিয়ে দাঁড়াল। পুলিশ ঠাণ্ডা মাথায় বিএনপির আক্রোশ নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সংঘর্ষ বেঁধে যায় কয়েক স্থানে। আহত হন বহু নেতাকর্মী।

অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের দালাল বলে দেশ টিভির সাংবাদিককে পিটিয়ে আহত করেছেন। ধানমন্ডিতে একই স্থানে আ.লীগ ও বিএনপি সমাবেশ ডাকলে পুলিশ আগের রাতেই সমাবেশ করতে নিষেধ করে দুটো দলকে। পরে বিএনপি সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করে যেকোনো মূল্যে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। রাত থেকেই বিএনপির নেতাকর্মীরা সমাবেশের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং কেন্দ্র থেকে স্থানীয় নেতাদের নির্দেশ দেন সব প্রস্তুতি গ্রহণ করে মাঠে থাকতে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু রাতেই জানান তিনি সমাবেশে যাবেন।

এভাবে রাজনীতিতে প্রকাশ্য লাঠি বাহিনী গড়ে উঠলে দেশের জনগণ অশহায় হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভিন্ন দিকে মোড় নিবে। প্রকাশে লাঠি নিয়ে রাজপথ মাড়ানো নেতাকর্মীরা রাষ্ট্র ও জনতার কাছে সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচিত হবে। তাদের আগামী জীবন হুমকির মূখে পড়তে পারে। রাজনৈতিক জোসে আজকের আচরণ আগত ভবিষ্যতে কাল হয়ে উঠবেই।

জানা যায়, সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে বিএনপির চার নেতা মারা যান। গুলিবিদ্ধ হন অনেক নেতা। এরপর শীর্ষ নেতারা ঘোষণা দেন এবার আর তারা মাঠ ছাড়বেন না। জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং দলের চার নেতাকর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকার ১৬টি স্থানে সমাবেশের অংশ হিসেবে গতকাল হাজারীবাগে সমাবেশ করে বিএনপি। সমাবেশের আগে লাঠি উঁচু করে এবং কেউ কেউ লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে মিছিল নিয়ে ঘটনাস্থলে আসতে থাকে। এ সময় পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাদের আটকে দেয়।

তবে বিএনপির নেতাকর্মীরা লাঠি উঁচু করেই পুলিশের সামনে স্লোগান দিতে থাকে। পুলিশ শত শত নেতাকর্মীর হাতে লাঠি দেখলেও কোনো অ্যাকশনে যায়নি। অন্যদিকে রাস্তার অপর প্রান্তে টালি অফিস রোডের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেখানেও পুলিশ তাদের ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশ আর কাউকে শৃঙ্খলিত রাখতে পারেননি। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, বেলা পৌনে ২টার দিকে হাজারীবাগের টালি অফিস রোডে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা লাঠি হাতে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা বাধা দেয়। এসময় দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ বাঁধে। উভয় দলের বেশ কয়েকজন কর্মীকে বেধড়ক লাঠিপেটা করতে দেখা যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে উভয় পক্ষ দুই দিকে সরে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশের মাঠে সমাবেশ শেষ করে বিএনপি।

এ বিষয়ে কর্তব্যরত ধানমন্ডি অঞ্চলের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার এহসানুল ফেরদৌস উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে তো লাঠির দরকার নেই। লাঠি থাকলে শান্তি বিনষ্ট হতে পারে। সে জন্য আমরা সমাবেশে আসা লোকজনকে লাঠি সরিয়ে ফেলতে বলেছি। শান্তভাবে ঘটনা মোকাবিলা করেছি।

রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনও ১৪ মাস বাকি। তার আগেই উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে মাঠের রাজনীতি। দেশের বৃহত্তম দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে রাজপথের মিছিল-সমাবেশ নিয়ে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে। কেউ মাঠ ছাড়ছে না। সভা-সমাবেশে উসকানিমূলক বক্তব্যে এটি আরও আশঙ্কা তৈরি করছে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পুলিশের ওপর হামলা করলে পুলিশ কী করবে, আঙুল চুষবে? ১৭ আগস্ট আরেকটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘বন্দুকের নল থেকে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়নি। রাজপথ থেকেই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে। খেলা হবে, খেলা। রাজপথে মোকাবিলা হবে। খেলা হবে নির্বাচনে, খেলা হবে রাজপথে। কী নিয়ে খেলবেন? ধরা খাবে বিএনপি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top