মুজিব মহাবিদ্যালয় থেকে সরকারী মুজিব কলেজ এবং আমার প্রিয় ক্যাম্পাস নিয়ে কিছু স্মৃতি

mnm-scaled.jpg

মোহাম্মদ মকছুদের রহমান মানিক ।।

আশির দশকের শুরুর দিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমার মুজিব মহাবিদ্যালয়ে প্রবেশ। তবে ছিয়াত্তরের পর থেকেই আমি মুজিব কলেজে সকাল বিকাল দুই বেলাই যাতায়ত করতাম। সেটা খেলাধুলার জন্য। আমি যেহেতু কলেজ গেইটেই থাকতাম সে কারনে আমার গোসল হতো কলেজ পুকুরে। খেলাধুলা করতাম কলেজের মাঠে। মূলত কলেজ মাঠই ছিলো আমার খেলার উঠান।

সেই সময়ে কলেজে জাসদ ছাত্রলীগের রমরমা অবস্থান। কলেজ মাঠে আমার অবস্থানের কারনে ছাত্রলীগের ভিপি মালেক ভাই, নবী ভাই (চাপরাশিরহাট), সেলিম ভাই, মিন্টু ভাই, আবদুল হাই ভাই, অহিদ উদ্দিন মিলন ভাই, মোজাম্মেল ভাই এরা আমাকে কলেজ ক্যাম্পাসে অনেক সুবিধা দিতেন।

একদিন শিবিরের আইয়ুব আলী হায়দার কে (চর হাজারী, বর্তমানে মেট্রো হোমস চট্টগ্রাম শাখায় কর্মরত) নবীভাই ও মিন্টু ভাই গরুর দড়ি দিয়ে কলেজের পশ্চিম ভবনের বারান্দায় বেঁধে রাখেন। দিনশেষে খেলাধুলা শেষ করে বাসায় যাবো এমন সময় দেখি আইয়ুব আলী হায়দার বারান্দায় বাঁধা। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনার এই অবস্থা কেন? কাহিনী শুনে আমি আইয়ুব আলী কে ছেড়ে দিই।

এটা জানাজানি হওয়ার পর নবী ভাই আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন হায়দারকে ছাড়লাম কেন? আমি বলি ভাই মানুষ কে গরুর মতো বেঁধে রেখেছেন ভালো দেখাচ্ছিলো না। তাছাড়া ভয়ে কাপড় নষ্ট করে ফেলেছে। কলেজ ক্যাম্পাসে আমার এই রকম অনেক স্মৃতি আছে।
পরে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আমি কলেজে ভর্তি হয়েই এক মাসের মধ্যে ছাত্রলীগের (জাসদ) সেক্রেটারি হয়ে গেলাম। অবশ্য এর আগে আমি স্কুল কমিটিরও সেক্রেটারি ছিলাম।

তবে সেই সময়ে মির্জা ভাইও আমাকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের সেক্রেটারি করার কথা জানিয়েছেন। আমার পরিবারের সবাই ছিলো আওয়ামী ঘরানার। শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থনই করতো না বরং আওয়ামী লীগের অর্থ যোগান দাতাও ছিলেন।

মূলত ১৯৮১ সালে বসুরহাট হাই স্কুল মাঠে জাসদের এক জনসভায় আমার জাসদ ছাত্রলীগের সাথে যাত্রা শুরু হয়। আমার জাসদ করার মূল কারন মিল্লাত লিটনের শ্রম। লিটন ভাই হলো মুজিব মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের প্রথম জিএস বেলায়েত হোসেন খসরু ভাইয়ের ছোট ভাই। তবে জাসদ ছাত্রলীগে আমি দৃশ্যমান হই কলেজে যাওয়ার পর। আমি মুজিব মহাবিদ্যালয় ছাত্রলীগের সেক্রেটারি হওয়ার আগে ছাত্রসংসদের দায়িত্বে ছিলেন মুজিববাদি ছাত্রলীগ। ভিপি ছিলেন আবদুল কাদের মির্জা। ফলে কিছুটা দুর্বল অবস্থায় ছাত্রলীগের সেক্রেটারি পদের দায়িত্ব নিই।
কিন্তু সেই সময়ে আমাদের একঝাক উদীয়মান নেতৃত্বে একবছরের মাথায় জাসদ ছাত্রলীগ বড় সংগঠনে রূপ নেই। সেই সময়ে আমার সাথে যোগদেন কাজল হাজরী, জাহাঙ্গীরসহ বেশ কয়েকজন সুঠাম দেহের পরিশ্রমী ছাত্র।

আমার সৌভাগ্যে ছিলো সেই সময়ে প্রায় স্কুল থেকে কলেজে যারা ভর্তি হয়েছেন তার বেশিরভাগই আমাদের ঘরণার ছাত্র ছিলো। ফলে ছাত্রলীগের ৫০/ ৬০ জনের একটি টিম সিরিয়াসলি কাজ করেছেন। আমাদের কলেজ কমিটি ক্লাস কমিটিসহ সকল স্কুল কমিটি ছিলো।
কলেজে ক্লাস কমিটির ফলে জাসদ ছাত্রলীগের সমর্থনে একচেটিয়া ছিলো ক্যাম্পাসে।

ছাত্রলীগকে সাফুল্যের চুড়ায় নিতে সেই সময়ে যাদের অবদান ছিলো অন্যতম ছিলো আমি মাকসুদ মানিক, কাজল হাজারী, দাম্বা মাইন উদ্দিন, শাহ আলম ফিরোজ, জাহাঙ্গীর, জসীমউদ্দীন, জয়নুল আবেদীন পলাশ, স্বপন, মামুন, আবদুর রহিম, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল হাই, গোলাম ছারওয়ার ১ ও ২, প্রবীর মিত্র, আবদুল হাই টুকু, ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল, নাহিদ , মোস্তফা, আজিজুল হক বকশিসহ আনেকেই। জুনিয়রদের মধ্যে ছিলো আরজু হাজারী, বেলাল, রায়হান, তানভীর তারেক, আবদুল্লাহ আল তারেক, করিমুল হক সাথী, সবুজ, মাইন উদ্দিন ছোট, আলমগীর, রকি, জাফর, মামুন বাবর, মুন্না, বকুল প্রমুখ। সিনিয়রদের মধ্যে ছিলো মোজাম্মেল ভাই, মিলন ভাই, হালিম ভাই, আলাউদ্দিন খোকন ভাই। সেই সময়ের দিনগুলো আজো শিহরণ জাগায়।

সারা রাত হাতে পোস্টার লেখা ভোরো কলেজ ক্যাম্পাসে পোস্টারিং করা । তৈমুর ভাইসহ সারারাত দেয়াল লিখন (চিকামারা)। শেষরাতে নবীর হোটেলে ভাত খাওয়া।

পুরো ক্যাম্পাসে ছিলো জাসদ ছাত্রলীগের রাজত্ব। আমরা যেদিন মিছিল করতাম সেদিন আর ক্লাস হতো না। স্যাররা রসিকতা করে বলতেন আজ তোরা মিছিল করবি এটা বললেতো আমরা আজ কলেজে আসতাম না।

আমাদের সময়ে জাসদে ছাত্রলীগের পাশাপাশি, মুজিববাদী ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবির ও ছাত্রসমাজের অবস্থান ছিলো। সেই সময়ে ছাত্রদলের খুব একটা অবস্থান ছিলো না।

মুজিববাদী ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন ইউনূস, রমেশ, জামাল উদ্দিন, শেখ আবদুল্লাহ, আবুল খায়ের, পিপল, সমীর,জামাল লিটন, জাহান, তোহা, আতীক, জসীম উদ্দীনসহ বেশ কিছু নেতা। শিবিরে ছিলো মুনীর, ছারওয়ার, শাহজাহান, কামাল এবং ছাত্রসমাজ ছিলো ফুটন, সিরাজ, ইফতেখার, মাহমুদ, বস খোকন, আমীন উদ্দিন মানিক, করীমসহ অনেকে‌।

আমি কলেজ থেকে বের হবার পরে কলেজ সরকারীকরণ হয়। নাম হয় সরকারী মুজিব কলেজ। কিন্তু কলেজের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছিলো। আমার প্রতিবাদের মুখে সেই সময়ের উপরাষ্ট্রপতি আর সাহস দেখালেন না‌।

কলেজ মাঠে এরশাদ আসবে, কলেজ সরকারি হবে। মওদুদ সাহেব সব ছাত্রসংগঠনের সাথে বসতে চান। কিন্তু আমরা দুই ছাত্রলীগ বসতে রাজি নয়। পরে মালেক ভিপির বিশেষ অনুরোধে আমিসহ ৪/৫ জন ডাকবাংলার বৈঠকে হাজির হই। অনেক আলোচনার পর হঠাৎ বস খোকন প্রস্তাব করলেন কলেজের নাম পরিবর্তন করে মওদুদ আহমদ সরকারী কলেজ করার জন্য। আমি তাৎক্ষণিক এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলাম।
আমি বললাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় নেতা। এই জাতির জনক। আমরা তার রাজনীতির বিরোধীতা করি ঠিক আছে। কিন্তু কলেজের নাম পরিবর্তন এটা মেনে নিবো না। আমার বিরোধীতার পর মওদুদ আহমেদ দাঁড়িয়ে বললেন বঙ্গবন্ধু আমারো নেতা। নাম পরিবর্তন হবে না। তাছাড়া কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম সভা আমি সভাপতিত্ব করি এবং কলেজের নাম বঙ্গবন্ধুর নামে হবে এই নামের প্রস্তাবকও আমি। এই ঘটনার পরদিন বস খোকনকে মির্জা ভাই-রা কলেজে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে।

এরপর নব্বইয়ের দশকে বাইন্নাগো সেলিম, খান সাহেবের নাতি টিপুরা, আলাল, মঞ্জু, বাদল আরিফদের নেতৃত্বে আবারো কলেজের নিয়ন্ত্রণ নেয় মুজিববাদী ছাত্রলীগ।

আশির দশকের প্রায় পুরো সময়টাই আমার প্রিয় ক্যাম্পাসে দিন রাত সময় কাটতো। সকাল ৯টায় কলেজ ক্যাম্পাসে ডুকতাম রাত ১০ টায় বের হতাম। কতো স্মৃতি, মায়া মমতা আবেগ অনুভূতি জড়িত এই কলেজ ক্যাম্পাসের ইট মাটি ঘাসের সাথে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রতিষ্ঠিত কলেজটির এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত রয়েছে।  তবে কলেজটি ধরে রাখতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত ও অধ্যক্ষ আবদূন নূর স্যার। খিজির হায়াত কলেজ মাঠে যাত্রাপালা চালিয়েও শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করেছেন।

যেসব স্যারেরা খেয়ে না খেয়েও কলেজে পাঠদান অব্যাহত রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম নূর স্যার, মমিন উল্যাহ স্যার, মমিনুল হক স্যার, সুমীর বাবু, দীপক বাবু স্যার, স্বপন বাবু স্যার, নারায়ন বদ্য স্যার, খুরশিদ স্যার, শাহজাহান স্যার, রহীম স্যার, মোহাম্মদ আলী স্যার, বিশ্বনাথ স্যার প্রমুখ। অনেকের নাম এখন আর মনে আসছে না। আমার স্যারদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

এবার কোরবানির ঈদের পর সম্ভবত ৭ জুলাই আমার দুই ছেলেকে নিয়ে আমার প্রাণের প্রতিষ্ঠান মুজিব কলেজ ক্যাম্পাসে কিছুটা সময় কাটায়। ছেলেদের সাথে আমার যৌবনের রঙিন সময়গুলো শেয়ার করি। আমার আজো মনে হয় এতো সুন্দর ও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস বাংলাদেশে আর একটিও নেই।

আরো অনেক সুন্দর স্মৃতি আছে কলেজ ক্যাম্পাস ও রাজনীতি নিয়ে যদি কখনো নিজেকে নিয়ে লেখার সুযোগ হয় লিখবো। সেই পর্যন্ত বিদায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top