বিএনপিকে ছাড়াই কী আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের দিকে হাঁটছে

ALBNP.jpg

মোহাম্মদ মকছুদের রহমান ।।

সরকার দল (আওয়ামী লীগ) বলছে সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন, বিএনপি বলছে শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচন নয়। এমন দাবির পক্ষে দুই বড় দলই অনঢ়। বিএনপির এক দফা দাবি যদি আওয়ামী লীগ মেনে নেয়, তাহলে রাজনৈতিকভাবে তাদের পরাজয় হবে, এমন ধারণা তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে বিএনপি যদি নির্বাচনে যায় তাহলে অনেকে ভাববে, দলটি রাজনৈতিক কৌশলে হেরে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের কেউ ছাড় দিতে চাইবে না। এমন অবস্থায় আলোচনা বা সমঝোতা সহজ নয়।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে, বিএনপি এক দফা দাবি তুলে আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আর আওয়ামী লীগ ১ দফা রাজনৈতিক কারনে মেনে নিবে না। ফলে বিএনপি ভোটের বাহিরে রেখেই জাতীয় নির্বাচনে দিকে এগুতে হবে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলটির নির্বাচনী কৌশলে বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলোকে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে না। সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই নির্বাচন করার পথে এগোচ্ছে তারা। তবে শেষ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনে এলে করণীয় কী হবে, সেই কৌশলও ঠিক করে রেখেছে ক্ষমতাসীন দলটি। সরকার ও আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফার আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি। দলটি এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন নয়, এই অবস্থানে অটল রয়েছে। বিএনপির এমন মনোভাব সম্পর্কে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে, বিএনপি এক দফা দাবি তুলে আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সে জন্য বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছেন দলটি। বিএনপি নিজে থেকে না এলে তাদের নির্বাচনে আনার কোনো উদ্যোগ সরকার নেবে না আওয়ামী লীগ।

পাশাপাশি বিএনপি বলছে, ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ আবার একতরফা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু একতরফা নির্বাচন করলে তা দেশের ভেতরে ও বাইরে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এর অংশ হিসেবে দলটি রাজপথের নিয়ন্ত্রণও নিতে চায়। সে জন্য তারা বিএনপির আন্দোলনের পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকছে। সারা দেশের দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্বাচনের বার্তা দিতে ৩০ জুলাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে। ঢাকার এই সভায় দলের জেলা-উপজেলার নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

এরইমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোটের জোট ১৪ দলীয় জোটকেও সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। ১৬ মাস পর গত বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকে তিনি আগের তিনটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় আগামী জাতীয় নির্বাচনও জোটগতভাবে করার কথা বলেছেন। ১৪ দলীয় জোটের একটি শরিক দলের শীর্ষ নেতা দিলীপ বড়ুয়া গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে একটি সংবাদ মিড়িয়াকে বলেছেন, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেভাবেই অগ্রসর হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচন নিয়ে শরিকদের মনে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই।

আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলের বৈঠকে ঢাকাসহ সারা দেশে জোটগতভাবে সভা-সমাবেশ করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, তাঁদের জোটের বাইরে জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে বলে তারা মনে করছেন। এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে নেই এমন কিছু দলকেও নির্বাচনে আনার চেষ্টা রয়েছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য রয়েছে, এ ধরনের ১৫-২০টি দলের একটি জোট গঠনেরও প্রক্রিয়া চলছে অনেক দিন ধরে। এর প্রায় সব কটিই ইসলামি দল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ চাইছে, ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টির বাইরে আরও বেশ কিছু দল ও জোট নির্বাচনে অংশ নিক। তাতে নির্বাচনে বিভিন্ন দল ও জোটের অংশগ্রহণ দেখানোর বিষয়টি সহজ হবে।

নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যুক্তরাষ্ট্র গত মে মাসে বিধিনিষেধ দিয়ে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। এরপর চলতি জুলাই মাসের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ঢাকায় সফরে এসেছিলেন। তিনি নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেছেন। এ ছাড়া নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রতিনিধিদলও ঢাকা সফর করছে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের তৎপরতাও এখন চোখে পড়ার মতো। তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা যেমন বলছেন, একই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের কথাও বলছেন।

এমন পরিস্থিতি একধরনের চাপ তৈরি করলেও সরকার তা কার্যত উপেক্ষা করছে। ১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বিদেশিদের তৎপরতাকে সরকার আমলে নিচ্ছে না। ১৪ দলও সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন করার পক্ষে রয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে সরকার ও দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে কঠোর মনোভাব দেখানো হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যাতে একতরফা বিরোধী দলের দিকে ঝুঁকে না যায়, সেই ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলের দাবিতে কোনো ছাড় দেবে না সরকার।

এবার শুরু থেকেই বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবির ব্যাপারেও প্রকাশ্যে কোনো ছাড় না দেওয়ার অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ। এখন তাদের এক দফা দাবিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ আরও কঠোর অবস্থানে গেছে। কিন্তু এক দফা ঘোষণার পর আর কোনো ছাড় না দেওয়ার বিষয়ে দলের ভেতরে এখন কোনো ভিন্নমত নেই। বিএনপি সেপ্টেম্বর মাসে আইনশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটানো বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। এমন ধারণা থেকে যথাসময়ে নির্বাচন করার লক্ষ্যে সরকার আরও কঠোর হতে পারে।

তবে বিএনপির নেতারা পরিস্থিতিটাকে ব্যাখ্যা করছেন ভিন্নভাবে। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের আন্দোলনের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় না দেওয়ার কথা বলে আসছে। এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা বাধ্য হয়ে এক দফা আন্দোলনে গেছি। এখন ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করতে চাইলে তা জনগণ বিচার করবে। তবে সেই নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।’

বিএনপির নেতারা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁদের পিছিয়ে আসার আর কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগের পক্ষে একতরফা নির্বাচন করা আগের মতো আর সহজ হবে না বলেই মনে করেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top