গোলাম ছারওয়ার ।।
জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান শুধু কী একটি নাম?শুধু কী জাতির পিতা, না-কি অন্য কিছু। ‘শেখ মুজিব’ নামটির সঙ্গে মিশে আছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ব্রম্মপুত্র মধুমতি, বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষ্যা পলল ভূমির পরিচয়। শেখ সাহেব ডাকটি যেন হাজার বছরের পরাধীন বাঙালির আত্মপ্রত্যয়ের ধ্বনি। এভাবে বঙ্গবন্ধু যেন ব্যক্তি কিংবা নেতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। আর তাই বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন ধ্রুবতারা, উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিশ্বনেতারাও সেটা মেনে নিলেন মুখ বুজে।
সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। হাজার বছরের পরাধীনতা, নিপীড়ন, নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠের কর্ণধর বীর বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রশস্ত বুকে ছিলো অসীম সাহস, ছিলো পাহাড়ের মতো দৃঢ় প্রত্যয়।
শোষণ-বঞ্চনায় দ্বি-খণ্ডিত মানুষের ব্যথায় তার আহত হৃদয় নৈঃশব্দে কেবলই কেঁদে উঠত। অন্যায় ও অপশাসনের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠস্বরও এমন ছিলো যে মৃত্যুভয়ও তাকে কুণ্ঠিত করতে পারেনি। জেল-জুলুম নিপীড়নের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে দমাতে পারেনি।
১৯৭১ সালে অসংখ্য বাঙালির মতোই বেশ কিছু বিদেশি নেতা ও কবি-সাহিত্যিক ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন, শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বেই এই দেশ স্বাধীন হবে। এলেন্স গিন্সবার্গ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অনডিউটি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে মূল্যায়ন করে এভাবে লিখেছেন, ‘এমন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে যে অনগ্রসর বাঙালি জাতিকে মুক্তির আস্বাদ দিবে। তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে একজন শক্তিমান কবির চিন্তাশক্তি, চিত্রকল্প, উপমা, শব্দচয়ন পরিলক্ষিত হয় বলেই তাকে রাজনীতির কবি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেওয়া হয়, ‘পয়েট অফ পলিটিক্স বলে’।
প্রাবন্ধিক সেলিনা হোসেন ‘৭ মার্চের ভাষণ ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক প্রবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু উপমহাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি স্বাধীনতার সঙ্গে একই সমান্তরালে মুক্তির সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করেছিলেন।’
ফ্রান্সের বিখ্যাত সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো বলেন, ‘স্টালিন নয়, হিটলার নয়, মাও সেতুং নয় মাহাত্মা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি জগৎ এখনও না বুঝে থাকে, না বুঝে থাকে এদের মতের মর্মবাণী, তবে সময় এসেছে এ বিষয়ে দৃষ্টি উন্মোচনের।’
প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সাতই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতির জয় হয়েছে, সেই জাতি একজন অবিসাংবাদিত নেতা পেয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন তার ‘গেটিসবার্গ ভাষণে’ গণতন্ত্রকে ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল’ বলে সংজ্ঞায়িত করেছন।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রষ্ট (১৯৭২ সালে এক সাক্ষাতৎকারে) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ তিনি অপকটে সে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালবাসি।’ সাংবাদিক আবারো জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার দুর্বল দিকটা কি?’ বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্নের জবাবেও বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালবাসি।’ বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন।
বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করে ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, ‘আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য।’
সদ্য স্বাধীনতা অর্জিত বাংলাদেশের কণ্ঠমণি-বিশ্ববীর বঙ্গবন্ধু নিষ্পেষিত, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য জাতিসংঘে ১৯৪৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ৫০টি ইস্যুর কথাসহ বাংগালী মাথা উঁচু করে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন বিশ্বের রথী-মহারথী নেতাদের সামনে যা আজও শোষিত, অধিকার বঞ্চিত ও বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়। ১৯৭১ সাল এবং তৎপরবর্তী শেখ মুজিব বিশ্বনেতাদের চোখে হয়ে ওঠেন বিস্ময়। ঘোর লাগা এক ব্যক্তিত্ব।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, হেনরি কিসিঞ্জার এর মূল্যায়নটি, ‘আওয়ামিলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী ত্রিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’
‘শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুই ইয়ের সাথে তুলনা করা যায়। জনগন তার কাছে এত প্রিয় ছিল যে লুই ইয়ের মত তিনি এ দাবী করতেই পারেন আমি ই রাষ্ট্র।’ — পশ্চিম জার্মানী পত্রিকা।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের মতে, ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।’
ফিনান্সিয়াল টাইমস বলেছে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিতনা।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সারা বিশ্ব যারা বলেছেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে।’ — নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট।
‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’ — ফিদেল কাস্ট্রো।
‘শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন।তার অনন্যসাধারন সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগনের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’ — ইন্দিরা গান্ধী।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতীষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’ — সাদ্দাম হোসেন।
‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’ — কেনেথা কাউণ্ডা।
‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে বাঙলাদেশই শুধু এতিম হয় নি বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’ — জেমসলামন্ড, ইংলিশ এমপি।
‘তোমরা আমার প্রিয়বন্ধু মুজিবকে হত্যা করলে! আমারই দেয়া ট্যাংক ব্যাবহার করে! আমি নিজেকেই অভিশাপ দিচ্ছি, কেন আমি তোমাদের ট্যাংক দিয়েছিলাম?’
আনোয়ার সাদাত (মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট)।
ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লক্ষ লক্ষ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছে। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’
তিনি ফিরে এসেছেন দৈহিক ভাবে কোটি বাংগালীর অন্তরে
একই দিনে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
গত কয়েক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক নেতার আবির্ভাব হয়েছিলো। সবার থেকে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে স্বীকৃত। লেনিন, ফিদেল কাস্ট্রোর মতো বঙ্গবন্ধুও সফল নেতা ছিলেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তি ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য।’
মনীষী লড ফেনার ব্রকওয়ে আরও একধাপ এগিয়ে দেখেছেন এভাবে, ‘জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেরারও চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা। শেখ মুজিবের সাহসিকতা ও ব্যক্তিত্ব কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয় সারাবিশ্বে বিরল।’
তিনি বিশ্বে একমাত্র জাতীয়তাবাদী নেতা, তিনি দলকে ও জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি প্রয়োজনে রক্তাক্ত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করেছেন
একারণেই তিনি বিশ্বনেতা। সমগ্র বাঙালি জাতির নেতা । তিনি শুধু বঙ্গের বন্ধু নন, সারাবিশ্বেরও বন্ধু। যতকাল বাংলাদেশ থাকবে ততকাল তিনি থাকবেন। জয়বাংলা জয় বংগবন্ধু।
লেখক : গোলাম ছারওয়ার, সাধারণ সম্পাদক, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী যুবলীগ।