এক দলীয় উপজেলা নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম, উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে জনমনে

upzilla-nirbacon.jpg

মোহাম্মদ মকছুদের রহমান ।।

৮ মে অনুষ্ঠিতব্য এক দলীয় উপজেলা নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম, উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে দলীয় রেষারেষির আসন্ন উপজেলা নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, খুনোখুনি, কেন্দ্র দখলের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রার্থীরা। এবারের উপজেলা নির্বাচনের প্রচারের শুরু থেকেই বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

উপজেলা নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন থামছে না। আচরণবিধি অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপিরা প্রচারসহ কোনো ধরনের নির্বাচনি কাজে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে অনেক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তার ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আসছে নির্বাচন কমিশনে। মন্ত্রী-এমপিরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনি মাঠ রয়েছেন। নির্বাচনি প্রচারে অনেকেই সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। প্রার্থীদের অভিযোগ-নির্বাচন কমিশনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হয় না। কমিশন তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

এবার উপজেলা নির্বাচন চার ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম ধাপের নির্বাচন ৮ মে। এ ধাপে ভোট হবে ১৪৮ উপজেলায়। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিলো ২১ মে। এ ধাপে ১৫৯ উপজেলায় ভোট হবে। তৃতীয় ধাপে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১২ মে। এ ধাপের নির্বাচন ২৯ মে। তৃতীয় ধাপে মোট ১১২ উপজেলায় ভোট হবে। সর্বশেষ চতুর্থ ধাপে ৫৫ উপজেলায় ভোট হবে ৫ জুন।

অনেকের অভিযোগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য নানা ধরনের চাপ আসছে। দ্বিতীয় ধাে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে অনেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য হুমকিধমকি ও চাপ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

উপজেলা নির্বাচনে কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে এ শঙ্কার কথা জানান তারা। নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাঠ প্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা ইসিকে বলেছেন, দলীয় কোন্দল ও মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার ঠেকানোই এ নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এ ছাড়া নির্বাচনে কোথাও কোথাও সংঘাতের আশঙ্কার কথাও বলছে প্রশাসন। তবে এ বিষয়ে অন্যতম নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেছেন, ভোটারদের বাধাগ্রস্ত করলে সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল হবে। এবারের নির্বাচন প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ হবে।

এবার উপজেলা কোন নির্বাচনে বিরোধী দল নেই। বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। আসলে এটা নির্বাচন নির্বাচন খেলা। তবে নির্বাচনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জনগণের অনুপস্থিতির সম্ভাবনা। নির্বাচন হচ্ছে প্রভাবমুক্ত হয়ে বেছে নেওয়া। কিন্তু এ নির্বাচনে প্রভাবমুক্ত হয়ে বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। আসলে এটা নির্বাচন নয়, মূলত প্রতিযোগিতা।’

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) ইমামুল হক সাগর বলেন, ‘জাতীয় কিংবা স্থানীয় সব নির্বাচনেই পুলিশের বিশেষ কিছু দিকনির্দেশনা থাকে। এবারও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সুষ্ঠু, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হয় এবং স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো এবং অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর যারাই নির্বাচন ঘিরে অপরাধমূলক কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট পৌরসভার মেয়র আবদুল মালেকের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ রিটার্নিং অফিসারের কাছে : লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধা ব্যবহার করে মেয়র আবদুল মালেক একজন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রচারের অভিযোগ উঠেছে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুল আনাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রার্থী ও দলীয় প্রার্থী পরিচয় দেওয়ায় তাঁকে কারণ দর্শনোর নোটিস দিয়েছেন রিটার্নিং অফিসার। ২৪ ঘণ্টার মধ্য তাঁকে নোটিসের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার ও সিনিয়ার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. নওয়াবুল ইসলাম বলেন, ‘সুবর্ণচর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুল আনাম চৌধুরী দলীয় প্রার্থী পরিচয় দিয়ে প্রচার করতে পারেন না। তিনি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না। এ নির্বাচনি আচরণবিধি অঙ্ঘনের অভিযোগে কারণ দর্শানো চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।’ এর আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরী একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

ভোটারদের বাধাগ্রস্ত করলে সাত বছরের জেল :
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেছেন, ভোটারদের বাধাগ্রস্ত করলে সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল হবে। এবারের নির্বাচন প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ হবে। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন নির্বিঘ্নে। ভোটে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়া হবে না। গতকাল চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে নির্বাচনি আচরণবিধি ও মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ মন্তব্য করেন তিনি।

উপজেলা নির্বাচনে এবারই সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকছে : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্রধারী সদস্য থাকবে। কেন্দ্রগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৭ থেকে ১৮ জন সদস্যসহ ছয়জন অস্ত্রধারী সদস্য থাকবেন। এর আগে কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত বেশি সদস্য ভোট কেন্দ্রে ছিলেন না। একই সঙ্গে প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। সভা শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেন, আমাদের ভোট কেন্দ্রের জন্য আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে পরিমাণ সদস্য ছিল, সেটা যথেষ্ট পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এখন প্রতিটি স্বাভাবিক কেন্দ্রে অস্ত্রসহ তিন পুলিশ, অস্ত্রসহ আনসারের পিসি ও এপিসি থাকবেন তিনজন। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্রধারী ছয়জন সদস্য থাকবেন। প্রতিটি বুথ ব্যবস্থাপনার জন্য সর্বনিম্ন ১০ জন আনসার সদস্য থাকবেন ও ছয়টির বেশি বুথ আছে এমন জায়গায় একজন করে অতিরিক্ত আনসার সদস্য থাকবেন। গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোয় অস্ত্রসহ চার পুলিশ সদস্য ও আনসার থাকবেন তিনজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মোট ১৭ থেকে ১৮ জন সদস্য থাকবেন। উপজেলা নির্বাচনে এর আগে কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত বেশি সদস্য ভোট কেন্দ্রে ছিলেন না।

সিনিয়র সচিব বলেন, যেহেতু ভোটের দিন ব্যালট পেপার পৌঁছানো হবে। এটা পৌঁছানোর কাজে নিয়োজিত থাকবে মোবাইল ফোর্স, স্ট্রাইকিং ফোর্স। ব্যালট পেপার সেন্টারে পৌঁছানোর পর তাদের এলাকাভিত্তিক যে দায়িত্ব বণ্টন করা হবে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার ও রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে আলাপ করে তারা যেটা বলবেন, সেভাবে তারা দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। প্রতিটি উপজেলায়ও একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। ভোটের আগের দিন ও পরের দিন পর্যন্ত তারা দায়িত্ব পালন করবেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভোট কেন্দ্রে এবারই এত বেশি অস্ত্রসহ পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য থাকছেন। এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। কাজেই ভোটও বেশি পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় স্থানীয় নির্বাচন সব সময় প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়।

স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, গড়ে পাঁচটি সেন্টারের জন্য স্ট্রাইকিং ফোর্স ও মোবাইল ফোর্স থাকবে। আনসার, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে এ মোবাইল ফোর্স গঠন করা হবে। আর উপকূলীয় এলাকাগুলোয় বিজিবির বদলে কোস্টগার্ড বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। পার্বত্য এলাকার কিছু দুর্গম সেন্টারে হেলিকপ্টারে পোলিং কর্মকর্তা ও ভোটের উপকরণ পৌঁছানো হবে। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত কোনো সহিংসতার খবর নেই বলে জানিয়ে সচিব বলেন, আমাদের কাছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই। তার পরও প্রতিটি বাহিনী সতর্ক থাকবে। সব বাহিনীর প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটা সমন্বয় সেল হবে। নির্বাচনসংক্রান্ত অভিযোগ ৯৯৯-এর মাধ্যমে গ্রহণ করা হবে।

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ নেই কেন
৮ মে থেকে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট অনুষ্ঠিত হবে। অল্প কয়েক দিন বাকি থাকলেও এ নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো উত্তাপ-উত্তেজনা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এক সময় ‘উৎসবমুখর’ পরিবেশে উপজেলাসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনগুলো নিয়ে বছর দশেক আগেও গ্রামগঞ্জে, মফস্‌সলে মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো। গত এক দশকে কী এমন ঘটল, যাতে এ নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে এত অনীহা বা অনাগ্রহ তৈরি হলো?

ভোট দিতে না পারা
ফেনীর পরশুরাম উপজেলার স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নুরুল আফসার আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে চান না। তাঁর ভাষায়, ‘কথা বলে কী লাভ? যা হওয়ার তো তা হচ্ছে। নির্বাচন আসছে শুনছি, কিন্তু ভোট দিতে পারি না।’ তার দাবি, ২০ বছর ধরে ভোট দিতে পারেননি। নুরুল আফসারের মতো বহু মানুষ গত কয়েকটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। এই নির্বাচনগুলোর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনগুলোও ছিল।

বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে ৬ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৯ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১০ জন বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। (উপজেলা নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ী ৬ চেয়ারম্যানসহ ২৫ জন, প্রথম আলো অনলাইন, ২৩ এপ্রিল ২০২৪)। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপেই যদি এত প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তাহলে পরবর্তী ধাপে এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে।

চট্টগ্রামের রাউজানে বিগত সময়ে কয়েক দফায় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের মতো এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও মনোনয়ন দাখিলকারী চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদের তিন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। (রাউজানে ভোট ছাড়াই জয়ী হচ্ছেন চেয়ারম্যান ও দুই ভাইস চেয়ারম্যান, প্রথম আলো অনলাইন, ২১ এপ্রিল ২০২৪)

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার এই প্রবণতা শুরু হলো কীভাবে? ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এরপর থেকে রাউজানে স্থানীয় সরকারের প্রায় সব পর্যায়ের নির্বাচনে বিনা ভোটের প্রচলন শুরু হয়।

রাউজানে যা ঘটেছে, তা কমবেশি সারা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের ১৫৩ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভের পর থেকেই পরবর্তী সব নির্বাচনে যেনতেনভাবে জয়লাভ করাই সরকারি দলের প্রার্থীদের প্রধান প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতার কাছ থেকে এরকম প্রবণতার ‘স্বীকারোক্তি’ পাওয়া গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমাদের প্রিয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সুযোগ্য সন্তান মাহবুব উর রহমান রুহেলকে জেতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি। …আমরা আর কোনো অবস্থায় অপকর্ম চাই না। ভোটবিহীন যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে আজকে বিএনপি ভোটকেন্দ্রে যায় না, আওয়ামী লীগও ভোটকেন্দ্রে যেতে চায় না।…’ (‘৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের প্রার্থী রুহেলকে জিতাতে আমরা অনেক অপকর্ম করেছি’,

উপজেলা, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ—স্থানীয় সরকারের এ ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলের মানুষেরা তাঁদের জনপ্রতিনিধি বাছাই করেন। এভাবে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রচর্চার একটি সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু ভোট দিতে না পারা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া কিংবা ভোটের মাঠে মন্ত্রী-এমপি–ক্ষমতাসীনদের যে দাপট গত এক দশকে বারবার দেখা গেছে, তাতে জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনগুলোও ‘একতরফা’ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে।

সরকারের কৌশল বনাম বিরোধী দলগুলোর বর্জন
নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের অনাগ্রহ বা অনীহার একটি কারণ হলো, বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী দলের উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত। স্থানীয় রাজনীতিতে উপজেলাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাবলয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরপরও বিরোধী দলগুলো কেন এ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিল? নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের পরাজয়ের শঙ্কা, নাকি অন্য কোনো রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে তারা এমন সিদ্ধান্তের পথে হাঁটল?

বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জন করার একটি অন্যতম কারণ হলো, আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে ‘ফাঁদে’ ফেলার চেষ্টা করেছিল। বিএনপি এ নির্বাচনে গেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সেটা কিছুটা হলেও কমাতে পারত সরকার। একই সঙ্গে এই প্রচারও শুরু করত যে সংসদ নির্বাচন না করে বিএনপি ভুল করেছে। উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি তাই সরকারের ‘ফাঁদে’ পা না দেওয়ার ‘কৃতিত্ব’ দাবি করতেই পারে।

বিরোধী দল ছাড়া উপজেলা নির্বাচন কেমন হবে?
এবারের উপজেলা নির্বাচনকে যেন ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখানো যায়, সে রকম একটি চেষ্টা সরকারের মধ্যে ছিল। এ কারণে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় সরকারের সেই কৌশল অনেকটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যেসব বিএনপি নেতা এখনো নির্বাচনের মাঠে আছেন, তাঁরা খুব বেশি সুবিধা করতে পারবেন, এমনটা প্রতীয়মান হচ্ছে না। ফলে এ নির্বাচনও কার্যত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের মতো আরেকটি ‘একতরফা’ (আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ) নির্বাচনে পরিণত হয়েছে।

এ রকম অবস্থায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানো ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে সরকার নানা রকম কৌশল নিয়েছে। এ কৌশল শেষ পর্যন্ত কতটা কাজে আসবে, তার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে গত ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত একটি বৈঠক থেকে। দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপারসহ (এসপি) স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এই বৈঠক হয়।

এই বৈঠকসংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নির্বাচনে ভোটারের আগ্রহ এবং কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শুরু থেকেই নানা কৌশল নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে মন্ত্রী-এমপির স্বজনকে প্রার্থী না হওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে গতকালের বৈঠকে একাধিক জেলার ডিসি-এসপি বলেছেন, শুধু তাঁদের আত্মীয়স্বজনই নন, প্রায় সব এমপির পছন্দের প্রার্থী রয়েছে। তাঁরা এসব প্রার্থীর পক্ষে যে ধরনের তৎপরতা চালান, তাতে নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখা কঠিন।’ (মন্ত্রী-এমপির ‘তৎপরতা’ নিয়ে শঙ্কা, সমকাল, ২৬ এপ্রিল ২০২৪)

উপজেলা, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় সরকারের এ ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলের মানুষেরা তাদের জনপ্রতিনিধি বাছাই করেন। এভাবে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রচর্চার একটি সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু ভোট দিতে না পারা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া কিংবা ভোটের মাঠে মন্ত্রী-এমপি–ক্ষমতাসীনদের যে দাপট গত এক দশকে বারবার দেখা গেছে, তাতে জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনগুলোও ‘একতরফা’ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top