আজ নোয়াখালীর কৃতিসন্তান সরকারী দলের নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের ৮৩ তম জন্মদিন

2023.jpg

বিশেষ প্রতিবেদক

আজ নোয়াখালীর কৃতিসন্তান কোম্পানীগঞ্জের গর্ব আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ৮৩তম জন্মদিন। কাগজপত্রমতে ১৯৪০ সালের ২৪ মে প্রখ্যাত আলেমেদ্বৗন কলকাতা আরীগড় মাদ্রাসা ও ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক পরবর্তী পুরান ঢাকার কায়েট্রলি জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মমতাজ উদ্দিন ও আম্বিায়া বেগমের ঘর আলো করে জন্মগ্রহন করেন।

কাগজে কলমে জন্মদিন মানে আমি একাধিকবার ব্যারিস্টার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম উনার আসল জন্মদিন জানতে। আমার প্রশ্ন শুনে ব্যারিস্টার সাহেব মুচকি হাসি দিতেন। কোনো উত্তর দিতেন না্। কারন ব্যারিস্টার সাহেব নিজেকে ভাষা সৈনিক বলে গর্ব করতেন। ১৯৪০ সালে জন্ম হলে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেয়া অসম্ভব। কারন ১৯৫২ সালে তিনি সর্বোচ্চ ফাইভ/সিক্সের ছাত্র। সে সময়ে ৭/৮ বছরে শিশুরা স্কুলে যেতো।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাহেব বাংলাদেশের রাজনীতিতে দাপটে একজন মানুষ ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমুলক মামলা আগরতলা মামলার সহকারী আইনজীবী হিসেবে যোগদিয়ে সাড়া পেলেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কে বিয়ে দেন বঙ্গবন্ধুর দোস্ত কবি জসীম উদ্দিনের মেয়ে হাসনা জসীম উদ্দীনের সাথে।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দীর্ঘসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে দোদান্ড প্রতাপে সরকার ও রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়ান। প্রটোকল ছাড়া চলা অভ্যাস ছিলো না। এই জন্য তিনি রাজনীতির বেশিরভাগ সময় সরকারী দল করেছেন।

আমার একাধিকবার সুযোগ হয়েছিলো ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ১৫৯ গুলশানের বাসায় যাওয়ার। আমরা সাংবাদিকতা করে বলে অনেক সময় চোখকান খোলা রেখেই চলি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বেডরুমে বিশাল আকারের বঙ্গবন্ধুর ছবি দেশে আমি উনাকে প্রশ্ন করেছিলাম স্যার আপনার বেডরুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি কেন? ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ উত্তর দিলে আমার নেতাতো বঙ্গবন্ধু। এছাড়া উনার অফিসেও বিশাল আকাশে বঙ্গবন্ধুর ছবি শোভা পেতো।

আমার চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক ও সাংবাদিকতা জীবনে এরকমভাবে নেতা আসক্ত কোনো মানুষকে আমি দেখিনি। এই জন্য আমি ব্যক্তিভাবে মানুষ ও লেখক মওদুদ আহমদ শ্রদ্ধা করতাম। বাংলাদেশের ৫০ বছরের প্রায় সবসরকারেই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের দোদান্ড প্রতাপ ছিলো আওয়ামী লীগের তথা শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০০ সাল ২০০৯ থেকে সময়কালে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সরকারী দলে প্রবেশের সুযোগ পাননি। তবে এই শেখ হাসিনা না হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্য কেউ থাকলো ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এসময়েও গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রণালয় পেতেন।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন, তিনি জামিল আকতার নামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ পাঠ করতেন, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পোস্ট মাস্টার জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া ও এরশাদর সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রণালয়ের সফল মন্ত্রী সফল মন্ত্রী ছিলেন। এই প্রতিযশা রাজনীতিবিদ শেখ মুজিব, জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক সঙ্গী ছিলেন। তবে শেখ মুজিব ও জিয়া দুই রাষ্ট্র নায়কই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একজন সফল রাজনীতিবিদ, একজন সফল লেখক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ছিলেন।
দেশের সকল সরকারই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন। কারণ সকল সরকারই মনে করতেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিয়ামক। শুধুমাত্র শেখ হাসিনা সরকার ছাড়া। ফলে মৃত্যুর আগ-মুহুর্ত সরকারী দল করার সুযোগ পাননি। তবে এই সময়ে তিনি বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সম্মানিত সিনিয়র সদস্য ছিলেন।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে আমি একবার প্রশ্ন করে ছিলাম আপনি বলেছিলেন আপনি আওয়ামী লীগের পরে আর কোন রাজনৈতিক দল করেন নি। তাহলে জাতীয় পার্টি, বিএনপিতে কিভাবে ছিলেন? তিনি উত্তরে বলে ছিলেন লেখালেখি করবেন না এমন শর্তে বলি, আমি আওয়ামী লীগের পরে সবসময়ে সরকারি দল করেছি। এলাকার উন্নয়নে আমাকে সরকারী দল করতে হয়েছে। আমি সরকারী দল না করলে এলাকার রাস্তাঘাট পুলকালভার্ট কে করতো।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আইন পেশায় পরিপূর্ণভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিলেও রাজনীতি থেকে কখনো দুরে সরে যান নি। দেশ পরিচালনা এবং নেতৃত্বদানের বিভিন্ন সুযোগ তাঁর জীবনে আসে। তিনি সেসব আহ্বানে যথাসময়ে যথাযথ ভাবে সাড়া দিয়ে দেশ ও জাতির প্রতি তার দায়িত্ববোধ এবং মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি এলাকার উন্নয়নে জীবনের বেশিরভাগ সময় সরকারি দল করেছেন। তিনি পাকিস্তান আমল, বঙ্গবন্ধু, জিয়া, এরশাদ, ১/১১ সময়ে ও মহাজোট সরকারের আমলে কারাভোগ করেছেন ।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে বিরল সম্মানের অধিকারী হন। উপমহাদেশের কোনো রাজনীতিবিদকে এ পযন্ত এই চেয়ারে সম্মানিত করা হয়নি। ভিজিটিং প্রফেসরের মর্যাদা দেয়া হয়নি। ব্যারিস্টার মওদুদের এই দুর্লভ সম্মানে গর্বিত, গৌরবান্বিত দেশ।

মরহুম ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের আজ ৮৩তম জন্মদিন। ১৯৪০ সালের এইদিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আজকের এইদিনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শাহী দরবারে ফরিয়াদ করছি মরহুম ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ স্যারের জীবনের সমস্ত ভুল-ত্রুটি মাফ করে উনার জীবনের ভালো কাজের উছিলায় উনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।

এই প্রতিশশা রাজনীতিবিদ ২০২১ সালের ১৬ মার্চ মৃত্যু বরণ করেন।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
——————————————————–
মওদুদ আহমদ ১৯৪০ সালের ২৪ মে নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন কলিকাতা আলীগড় মাদ্রাসা ও ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। মাতা আম্বিয়া খাতুন। ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। মওদুদ আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান পাস করে বৃটেনের লন্ডনের লিঙ্কন্স্ ইন থেকে অর্জন করেন বার-অ্যাট-ল।

ঢাকা কলেজে পড়াকালীন সময়ে ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অ্যাডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রব্বানীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশক্তির নেতা ছিলেন।

বার-অ্যাট-ল পাস করে দেশে ফিরে হাইকোর্টে ওকালতির একপর্যায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন আইনি লড়াইয়ে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই করতে খ্যাতনামা বৃটিশ আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসিকে বাংলাদেশে আনতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি প্রবাসী সরকারের পোস্ট মাস্টার জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর এপিএস ছিলেন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত।

১৯৭৭-৭৮ সালে জেনারেল জিয়ার সরকারে মওদুদ আহমদ ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি নোয়াখালী ৫ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯-৮০ সালে তিনি বিদ্যুৎ পানিসম্পদ ও বন্য নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। এ সময় তিনি সংসদের উপ নেতা নির্বাচিত হন।

এরপর তিনি ১৯৮৬-৮৮ সালে আরেক সামরিক সরকার এরশাদের শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে মওদুদ আহমদ ৩য়বার সাংসদ নির্বাচিত হন এবং একই সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করে নোয়াখালীর গৌরব বৃদ্ধি করেন। ১৯৮৮-৮৯ পযন্ত তিনি ছিলেন সংসদ নেতা। ১৯৮৯-৯০ সালে এরশাদ তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রদান করেন। জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন তিন সরকারের আমলেই ছিলেন ক্ষমতার নিউক্লিয়ার্সে ছিলেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ জীবনের বেশিরভাগ সময়ে স্বৈরশাসকদের সাথে দল করেছেন।  গণআন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতনের পর পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে নোয়াখালী-৫ আসনে জাসদের সহযোগিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

এরপর ১৯৯৬ সালে নোয়াখালী -৫ আসনে পরাজিত হয়ে আবারো বিএনপিতে যোগদেন এবং ১৯৯৬ সালে বেগম জিয়া আসন রায়পুর থেকে নির্বাচন করেন এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। পরে ২০০১ সালের নির্বাচনেও তিনি আবারো নোয়াখালী-৫ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে তিনি নিজ এলাকায় পরাজিত হয়ে আবারো বগুড়াতে বেগম জিয়ার আসনে উপনির্বাচনে ৬ষ্ঠবার এমপি নির্বাচিত হন।

বৃহত্তর নোয়াখালীর কৃতি সন্তান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের রচয়িতা। ১৯৭৯ সালে সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি এবং ঢাকার ইউনিভার্সিটি প্রেস লি. এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশ করে ‘দ্যা এ্যরা অব শেখ মুজিব’ বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিবুর রহমান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৫ সালে ঢাকার ইউনিভার্সিটি প্রেস লিঃ প্রকাশ করে ডেমোক্রেসী এন্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট এ স্টাডি অব পলিটিক্স এন্ড মিলিটারী ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ। এসব গ্রন্থ মূল্যবান গ্রন্থ অত্যন্ত সুলিখিত ও সুচিন্তিত। এসব গ্রন্থ দেশ বিদেশের পাঠকদের কাছেও সমাদৃত হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব হাইডেলবার্গ জনাব মওদুদ আহমদকে ১৯৭৬, ১৯৮০ এবং ১৯৯৬ সালে ফেলোশীপ প্রদান করে। ১৯৮০-৮১ সালে ফেলোশীপ প্রদান করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার পর ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স।

এ ছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাইজ তাকে ফেলোশীপ দেয় ১৯৯৩ সালে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের জ্যৈষ্ঠ কন্যা হাসনা জসীমউদ্দীনের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের সাবেক অধ্যাপক ও জাতীয় পার্টি থেকে নির্বচিত সাবেক এমপি। তিনি এক কন্যাসন্তানের জনক। তার ছেলে আসিফ ও আমান দুজনই মারা যান।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top