টানা ছুটিতে কক্সবাজারে পর্যটকের ভিড়

Coxbazar.jpg

সীমান্ত চৌধুরী ।।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতিমা বিসর্জন, সাপ্তাহিক ও ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) টানা ছুটি উপলক্ষে কক্সবাজারে লাখো পর্যটকের ঢল নেমেছে। বুধবার (৫ অক্টোবর) বিকেলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার শেষদিনে দেশের সবচেয়ে বড় আয়োজনে সৈকতে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছে। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি দেখা গেছে দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে।

এদিকে, বিসর্জনের পরেরদিন থেকেই পড়েছে সাপ্তাহিক ছুটি ও রবিবার ১০ অক্টোবর ১২ রবিউল আউয়াল, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। পূজা, সাপ্তাহিক সবমিলিয়ে অবসর কাটাতে মৌসুমের প্রথম কক্সবাজারে ভিড় করেছেন পর্যটকরা। বুধবার সকাল থেকে পর্যটকের ঢল নেমেছে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে। কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্ট, হিমছড়ি, ইনানীসহ সকল পর্যটক স্পট পর্যটকে সরগরম হয়ে উঠেছে। ভিড় রয়েছে শহর ও পর্যটন এলাকার বিভিন্ন সড়ক-উপসড়কেও। রিজার্ভ ছাড়া যাত্রী না তোলায় রীতিমতো দেখা দিয়েছে যানবাহন সংকট। গণপরিবহণগুলো পর্যটকদের রিজার্ভ ভাড়া ধরতে গিয়ে স্থানীয়দের এড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ প্রতিনিয়ত।

অনেকের ভাষায় দেশে নিরব অভাব, অর্থনৈতিক মন্দা, মানুষের হাতে টাকা নেই, এসবকে কথার কথা মনে হবে কক্সবাজারে মনুষের ঢল দেখলে। পকেট ভর্তি টাকা আর মনের সুখ না থাকলে কক্সবাজারে মানুষের এরকম ভিড় দেখাই যেত না। পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানা কয়েকদিনের ছুটিতে কয়েকশ’ কোটি ব্যবসা হতে পারে। করোনা মহামারীর ধাক্কা ফুসিয়ে নিতে সহয়ক হবে এবারের পর্যটক ভিড়। তাই এত পর্যটক আগমনে খুশি পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজারের প্রায় সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ রয়েছে, যেখানে লক্ষাধিক পর্যটক অবস্থান করতে পারেন। অক্টোবরের শুরু থেকে পর্যটক আগমন ভালো দেখা দিয়েছে। সব হোটেলে প্রায় বুকিং। যেহেতু পর্যটন মৌসুম শুরু হয়েছে, এ ভিড়টি শুভ লক্ষ্মণ। আমাদের চাওয়া এটি অব্যাহত থাকুক।

কক্সবাজার রেস্তোরাঁর মালিক সমিতির নেতা রাসেদুল ইসলাম ডালিম জানান, বুধবার সকাল থেকে পর্যটকের সমাগম চোখে পড়ে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সেটি আরও বেড়েছে। আশা করি এই চাপ আগামী আরও কয়েকদিন থাকবে। ট্যুর অপারেটর ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি রেজাউল করিম জানান, টানা কয়েকদিনের ছুটিতে লাখো পর্যটকের সমাগম এটা প্রতিবছর হয়। এবার বিসর্জনের বন্ধ একসঙ্গে হওয়ায় আরও বেশি এসেছে মানুষ।

তার মতে, অন্য বছর এসময়ে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়। মৌসুমের প্রথম যারা আসেন তাদের ৭০ শতাংশ একরাত কক্সবাজার থেকে পরের দিন সেন্টমার্টিন যেতেন। এবারও চাহিদা ছিল, কিন্তু আমরা ব্যবস্থা করতে পারিনি। আমাদের মনে হচ্ছে এবার সেন্টমার্টিন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। প্রতিবছর পর্যটকরা সহজে অল্প খরচে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন যেতেন, কিন্তু এবছর একটি চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পর্যটকরা সেন্টমার্টিন যেতে পারবে না।

ঢাকার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে বেড়াতে আসা ইব্রাহিম ও মৌরিন দম্পতি জানান, বিয়ের প্রথম কক্সবাজারে এসেছি। বিশাল সাগরের ঢেউ, অবারিত প্রকৃতি আল্লাহর নিয়ামত। দেখলেই মনটা ভারমুক্ত হয়।

ফেনীর ছাগলনাইয়া থেকে বেড়াতে আসা শিক্ষার্থীদলের কৃষ্ণ আচার্য বলেন, কক্সবাজার বললে যে আবহ মানুষের মানসপটে ভাসে-সেই তুলনায় চারপাশটা অগোছালো। ময়লা, আবর্জনা, অপরিকল্পিত স্থাপনায় মনে হচ্ছে এটি ইট-পাথরের কোন বস্তি। সৈকত দেখলে যে আনন্দ লাগে, পেছনে ফিরলে তেমনটি লাগে বেদনা। পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে তদারকি নেই বললেই চলে। অল্প চোখের দূরত্বে ইজিবাইক ভাড়া ১০০ টাকা নিচে যায়ই না। দলবদ্ধ হলে পুরো গাড়ি নেওয়া যায়, কিন্তু দুজন বা সিঙ্গেল হলেও রিজার্ভ ছাড়া যাত্রী তুলেই না। পর্যটন এলাকায় খরচ বাড়লে লোকজন বিমুখ হন।

পাঁচ তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু জানান, দুর্গাপূজা ও সাপ্তাহিক ছুটিতে কক্সবাজারে অনেক ভিআইপিসহ পর্যটকরা এসেছেন। তারকা মানের হোটেলগুলোর অধিকাংশ কক্ষ আগে থেকেই বুকিং ছিল। সামনের দিনগুলো এভাবেই কাটুক এ প্রত্যাশা আমাদের।

হোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, বিশ্ববাসীর নানারবাড়ি কক্সবাজারে পর্যটক ও স্থানীয় ভ্রমণ পিপাসুদের পদচারণা বেড়েছে। চলতি মাস থেকে আগামী মার্চ পর্যন্ত ছুটি ছাড়াও প্রচুর পর্যটক আসবে, এ বিশ্বাস আমাদের। সেভাবেই আমরা পর্যটক সেবার মানসিকতায় প্রস্তুত আছি।

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, টানা কয়েকদিনের ছুটিতে লাখো পর্যটকের উপস্থিতির কথা মাথায় রেখে- পৌরসভার পক্ষ থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে কাজ করছে পৌর কর্তৃপক্ষ।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, বিপুল পর্যটকের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ সবসময় প্রস্তুত। প্রতিটি পয়েন্টে পোষাকে ও সাদা পোশাকে কাজ করছে পুলিশ। পর্যটকদের সুবিধার জন্য সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট ট্যুরিস্ট পুলিশের হেল্প ডেক্স বসানো হয়েছে। কেউ যেন হয়রানীর শিকার না হন সেটাই আমাদের লক্ষ্য।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, দুর্গোৎসবের শেষ দিন হতে লোকসমাগম বেড়েছে। সেটা মাথায় রেখেই শুধু সৈকত এলাকায় প্রায় কয়েকশ ফোর্স মোতায়েন রয়েছে। পর্যটনসহ পুরো শহরে তিন স্তরে নিরাপত্তা জোরদার রয়েছে। যানজট নিরসনে সৈকতের কলাতলী থেকে আশপাশের সড়কগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান বলেন, প্রতিমা বিসর্জন এবং সাপ্তাহিক ছুটিসহ ৫ দিনের ছুটি উপলক্ষে বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত কক্সবাজারে লাখো মানুষের ঢল নেমেছে। পর্যটন সম্ভাবনাময় শিল্প- পর্যটন মৌসুমে ছুটি ছাড়াও কক্সবাজারে হাজার হাজার পর্যটক আসবে। পর্যটকরা কক্সবাজারের মেহমান, রাজস্বের লক্ষ্মী।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর বলেন, পর্যটক হয়রানি বন্ধে হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় মূল্য তালিকা টাঙ্গানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মাঠে রয়েছে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত। সকল ধরণে নিরাপত্তা জোরদারে পুলিশের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও কাজ করছে। এ পর্যন্ত কোন ধরণের শৃঙ্খল বিশৃঙ্খলার খবর আসেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top