আগস্ট মাসে আরো তীব্র হবে ডেল্টা সংক্রমণ

corona-2020.jpg

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

আইইডিসিআর উপদেষ্টা  ডা. মুশতাক হোসেন মন্তব্য করেছেন চলতি আগস্টে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আরও জটিল ও গুরুতর পরিস্থিতি হতে পারে।  ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা করোনা সংক্রমণকে দিন দিন তীব্রতর করেছে। বড় সংকটে রয়েছে গোটা দেশ। দীর্ঘদিন ধরে চলমান লকডাউনে নেমেছে স্থবিরতা। প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু গেলো ৮ মে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের মাধ্যমে শুরু হয় করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডব।

প্রতিদিনের নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার এখন ৩০ শতাংশের ওপরে। হাসপাতালজুড়ে শুধুই কোভিড রোগী। কোথাও যেনো তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আইসিইউর জন্য হাহাকার এখন শহরজুড়ে। ফলে মৃত্যু বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রতিদিন দুইশর ওপরে হচ্ছে মৃত্যু। অধিকাংশ মারা যাচ্ছে হাসপাতালে। গত এক সপ্তাহে বেড়েছে নমুনা পরীক্ষা ও শনাক্তের হার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে সপ্তাহে ৫৯ দশমিক ৯১ শতাংশ বেড়েছে নমুনা পরীক্ষা। মৃত্যুও বেড়েছে ১৯ শতাংশের ওপরে। ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণে জারিকৃত লকডাউনও তেমন কাজে আসছে না।

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা করোনা সংক্রমণের পরের  ঈদের আগে মানবিক কারনৈ বিধিনিষেধ শিথিল করলেও ২৩ জুলাই থেকে ফের কার্যকর করা হয়। আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিধিনিষেধে কঠোরতা থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জনস্বাস্থ্যবিদদের মত লকডাউন যেনো বাড়ানো হয়।

কারণ সংক্রমণ হার কমিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে জায়গা হবে না দেশের হাসপাতালে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও সে কথা স্বীকার করেছেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যাল্যয়ের ফিল্ড হাসপাতাল পরির্দশন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এভাবে রোগী বাড়তে থাকলে হাসপাতালে জায়গা হবে না। কিন্তু এসব নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আজ থেকে চালু হচ্ছে দেশের গার্মেন্ট-শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এজন্য গতকাল সকাল থেকে লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে চাকরি বাঁচাতে সারা দেশ থেকে শ্রমিকরা আসতে থাকে নিজ নিজ কর্মস্থলে। এদিকে শ্রমিকদের কর্মস্থলে আসার ক্ষেত্রে কোনো পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক পিকআপে গাদাগাদি করে আসতে হয়েছে শহরে। উপেক্ষিত ছিলো স্বাস্থ্যবিধি। ফলে করোনার ভয়াবহ বিস্তারের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগস্টে দেশের করোনা সংক্রমণ আরও ভয়াবহভাবে ছড়াতে পারে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। এদিকে লকডাউন শিথিলের বিষয়ে আভাস দিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। গতকাল তিনি জানিয়েছেন, করোনা প্রতিরোধে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা শিথিল করার চিন্তা করছে সরকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগের তথ্যমতে, সারা দেশে ২৭ হাজার ৯৭২টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১২ হাজার ৪৪৮টি, ময়মনসিংহে এক হাজার ২৩টি, চট্টগ্রামে পাঁচ হাজার ৬৬২টি, রাজশাহীতে চার হাজার ১১১টি, রংপুরে এক হাজার ৮১১টি, খুলনায় ৪৩৯টি, বরিশালে এক হাজার ৫২০টি ও সিলেটে ৯৫৮টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। এদিকে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে এক হাজার ৮৮১টি। তার মধ্যে ঢাকায় এক হাজার ৬০টি, ময়মনসিংহে ৬৫টি, চট্টগ্রামে ২১৯টি, রাজশাহীতে ১৪৬টি, রংপুরে ৬৭টি, খুলনায় ১৯১টি, বরিশাল ১১১টি ও সিলেটে ২২টি হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। দুই হাজার ৮৮টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় ৫৭৭টি, ময়মনসিংহে ৪৯টি, চট্টগ্রামে ৬৫৯টি, রাজশাহীতে ৪১৫টি, রংপুরে ৯৯টি, খুলনায় ১৮০টি, বরিশাল ৫২টি ও সিলেটে ৫৭টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে। এছাড়াও সারা দেশের ১০৯টি কোভিড হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৫টি ঢাকা বিভাগে। ময়মনসিংহে তিনটি, চট্টগ্রামে ১৪টি, রাজশাহীতে সাতটি, রংপুরে ১২টি, খুলনায় ১০টি, বরিশালে ছয়টি এবং সিলেটে আরও দুইটি।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সংক্রমণ ও শনাক্তে এখন যে প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার কারণ জুলাইয়ের শুরুর দিকে লকডাউনের পরিস্থিতির সময় আমরা খুব একটা উন্নতি করতে পারিনি। আর শিথিল লকডাউনের দুই সপ্তাহ পূর্ণ হবে আগামী সপ্তাহে। তার প্রভাব দেখা যাবে আগস্টের প্রথম নাগাদ, তারও এক সপ্তাহ পর দেখা যাবে মৃত্যু পরিস্থিতি। তিনি বলেন, মার্চে সংক্রমণ বেড়েছে, জুনে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, জুলাইয়ে কঠিন হয়েছে আর আগস্টে আরও জটিল, আরও গুরুতর পরিস্থিতি হতে পারে।

করোনার সর্বশেষ পরিস্থিতি : সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ১৩২টি আরটিপিসিআর, ৪৬৪টি র্যাপিড অ্যান্টিজেন ও ৫৩টি জিন এক্সপার্ট ল্যাবসহ ৬৪৯টি ল্যাবে গতকাল আরও ৩০ হাজার ৯৭৬টি নমুনা সংগ্রহ ও ৩০ হাজার ৯৮০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭৭ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫৬ লাখ ৯৫ হাজার ৩৬২টি আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আরও ২০ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে নতুন করে আরও ৯ হাজার ৩৬৯ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪৯ হাজার ৪৮৪ জনে। তার মধ্যে গতকাল সুস্থ হওয়া ১৪ হাজার ১৭ জনসহ এ পর্যন্ত সুস্থ রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৭৮ হাজার ২১২ জনে। এছাড়াও গতকাল ২১৮ জনের মৃত্যুতে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৬৮৫ জনে। গতকাল শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। সুস্থতার হার ৮৬ দশমিক ২৯ শতাংশ ও মৃত্যুহার ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতি ১০ লাখে শনাক্ত হচ্ছে ৭ হাজার ৩৮৮ দশমিক ছয়জন, তার মধ্যে সুস্থ হয়েছে ৬ হাজার ৩৭৫ দশমিক আটজন এবং মৃত্যু হয়েছে ১২২ দশমিক ৩২ জন।

গতকাল মৃত্যুবরণকৃত ২১৮ জনের মধ্যে ১৩৪ জন পুুরুষ ও ৮৪ জন নারী। এ পর্যন্ত ২০ হাজার ৬৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ১৪ হাজার তিনজন পুরুষ ও ছয় হাজার ৬৮২ জন নারী। শতাংশের হিসাবে মোট মৃত্যুর ৬৭ দশমিক শূন্য ৭০ শতাংশ পুরুষ ও ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ নারীর মৃত্যু হয়েছে। বয়সের বিবেচনায় একশো বছরের ঊর্ধ্বে গতকাল দুইজন, ৯১ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ৮১ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে ১৫ জন, ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে ৩৩ জন, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ৬৬ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে রয়েছে ৩৭ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ৩৭ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ১৭ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছয়জন এবং ১০ বছরের নিচে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত একশো বছরের ঊর্ধ্বে মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের। ৯১ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে রয়েছে ২২৯ জন, ৮১ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে এক হাজার ১৩৬ জন, ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে তিন হাজার ৫৯২ জন, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ছয় হাজার ৪৩০ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে চার হাজার ৯১৩ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের দুই হাজার ৪৯৭ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে এক হাজার ২১২ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের ৪৫৮ জন, ১১ থেকে ২০ বছরের ১৩৩ জন ও ১০ বছরের নিচে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

গতকাল মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৬৭ জন, খুলনার ২৭ জন, চট্টগ্রামের ৫৫ জন, রাজশাহীর ২২ জন, বরিশালে ১০ জন, সিলেটে ৯ জন, রংপুরের ১৬ এবং ময়নসিংহের ১২ জন। এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৪৮১ জন। খুলনায় দুই হাজার ৭৫৩ জন, চট্টগ্রামে তিন হাজার ৮৬১ জন, রাজশাহী এক হাজার ৫৯৬ জন, বরিশালে ৬৫৬ জন, সিলেটে ৭৬২ জন, রংপুরে এক হাজার ২৫ জন এবং ময়নসিংহের ৫৫১ জন। শতকরা হিসাবে মোট মৃত্যুর ৪৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ ঢাকা বিভাগের। এরপরে চট্টগ্রামে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, খুলনায় ১৩ দশমিক ৩১ শতাংশ, রাজশাহী ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, রংপুরে ৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ, সিলেট ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ, বরিশাল ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top