রাজনৈতিক শোডাউন থেকে মানুষ বাঁচানোর শোডাউনই এখন বেশি জরুরী

dANGU-fF.jpg

মীর মোশাররফ হোসেন পাকবীর ।।

দেশজুড়ে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মশাবাহিত রোগটিতে সারাদেশে রেকর্ড ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা গত পাঁচ বছরে ডেঙ্গুতে একদিনে সর্বোচ্চ। এতে মশাবাহী রোগটিতে এ বছর এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৭ জনে। একই সময়ে নতুন করে ১ হাজার ৫৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজারে।

চলতি মাসে ৫৩ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ২০ হাজার। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে নতুন করে আরও এক হাজার ৫৩৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৭৭৯ জন ঢাকায় চিকিৎসাধীন। বাকি ৭৫৪ জন রাজধানীর বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই সময়ে নতুন করে আরও ১৩ জন মারা গেছেন। ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৭ জনে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে, প্লাজমা লিকেজসহ হেমারোজিক শক সিন্ড্রোমে ঘটতে পারে মৃত্যু। শনাক্ত হলেই চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেন তারা।

সাধারনত পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গু জন্মালেও ধরন পাল্টে এডিশ মশা এখন ডিম পাড়ছে ময়লা পানিতেও। এমনি নতুন এ ধরন শুধু দিনে নয়, সংক্রমন ঘটাচ্ছে রাতেও। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যত নেই কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম।

পূর্বে আমরা দেখেছি, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সরকারের নানা ধরনের মশা নিধন কার্যক্রম ছিল। সরকারি উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে বাড়ি-স্কুল-অফিসের আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করা হত। এজন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীও ছিল। বাড়িতে বাড়িতে কার্যকরী মশা নিধনের ঔষধও দেয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে এধরনের কার্যক্রম নেই।

মশা নিধনের জন্য বর্তমানে যে ঔষধ প্রয়োগ করা হয়, তাতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় ঔষধ নেই বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে, ঔষধ দেয়ার পরেও মশা মারা সম্ভব হয় না।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এডিশ মশার উৎস খুঁজে বের করার জন্য ড্রোন উড়িয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়ির ও নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদ ও আশেপাশের এলাকা পরীক্ষা করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভবন মালিকদের জরিমানাও করছে। কিন্তু সচেতনতা বৃদ্ধিতে এধরনের উদ্যোগ খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না।

সরকারি অনেক অফিস-আদালত, কলকারখানা ও স্থাপনায় বিশাল এলাকা জুড়ে এডিশ মশার বংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রায়শই এসব স্থাপনার ভেতর পানি জমে থাকলেও এসব স্থাপনা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকা বিভিন্ন ক্ষুদ্র জলাশয়, আবদ্ধ খাল, লেক ইত্যাদিও এখন এডিশ মশার প্রজননস্থলে পরিণত হয়েছে।

সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা সাধারণত একেকদিন একেক এলাকায় মশা নিধনের ঔষধ দিয়ে থাকে। ফলে কোন এলাকায় ঔষধ দিলে মশারা খুব সহজেই অন্য এলাকায় সরে গিয়ে বংশবৃদ্ধি করছে। এজন্য এই কার্যক্রমের বস্তুত কোন কার্যকারিতা নেই। সিটি কর্পোরেশনগুলোর উচিৎ একই দিনে একসাথে বিভিন্ন এলাকায় মশার ঔষধ স্প্রে করা। তাহলে মশা দূর করা বহুলাংশে সম্ভব।

ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ংকর। রাজধানীর কোন সরকারি হাসপাতালেই কোন ওয়ার্ড, কেবিন বা বেড খালি নেই বরং সিটের কয়েকগুণ অতরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালের অবস্থাও প্রায় একই। সবজায়গা ডেঙ্গু রোগীতে পরিপূর্ণ। ঢাকার বাইরে থেকেও প্রতিদিনই শত শত ডেঙ্গু রোগী ঢাকায় চিকিৎসার জন্য আসছে। ডেঙ্গুর মূল আক্রমণ সাধারণত আগস্ট মাসে হয়ে থাকে। অথচ এবার মধ্য জুলাই-এই অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সামনের দিনগুলো তাই হয়ত আরও ভয়াবহই হতে চলেছে।

দেশে যখন হাসপাতালগুলোতে সামর্থের চেয়ে তিনগুণ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি এবং আরও অনেক রোগী ভর্তির অপেক্ষায়, তখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে মানুষের পাশে দাঁড়াবার কোন চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি দল উন্নয়ন ও শান্তি যাত্রা এবং বিরোধী দল সরকার পতনের লক্ষ্যে পদযাত্রা বা জয়যাত্রা করছে।

সকল রাজনৈতিক দলের কর্মীরা যদি মশার প্রজনন ও আবাস স্থল নির্মূলে কোন কর্মসূচী হাতে নিত, তবে তা তাদের জনবান্ধবতার প্রমাণ হতো।
রাজনৈতিক দলগুলো যেমন ১৮ ও ১৯ জুলাই উন্নয়ন ও শান্তি যাত্রা এবং পদযাত্রা বা জয়যাত্রার নামে পশ্চিমাদের কাছে রাজনৈতিক শোডাউন করছে, তেমন দুইদিন যদি তারা ডেঙ্গু মোকাবেলায় মশার প্রজনন ও আবাসস্থল নির্মূলে শোডাউন করে, তবে ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গু নির্মূল করা অনেকাংশেই সম্ভব। তারা যদি এধরনের উদ্যোগ নেয়, তবে সাধারণ মানুষও তাদের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে যোগ দিবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষের দুর্দশা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে তেমন একটা নাড়া দিচ্ছে না। তারা তাদের ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনা নিয়েই ব্যস্ত।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝা উচিৎ, দেশের মানুষ বাঁচলে দেশ বাঁচবে। আজ ভোটাররা ভোট দিতে কেন্দ্রে যায় না। কারণ, জনকল্যাণমূলক কাজে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় জনগণ ক্রমেই রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই অবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোকেই পরিবর্তন করতে হবে।

আমরা আশা করি, ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও মানুষের দুর্ভোগ বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু সত্যিকারের বাস্তবমুখী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনগণের পাশে দাঁড়াবে। তাহলেই শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকা ও সারাদেশকে অন্য অনেক অদেখা শত্রুর আগে মশার হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে এবং প্রমাণ হবে যে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিই জনবান্ধব। তাই, রাজনৈতিক শোডাউন থেকে মানুষ বাঁচানোর শোডাউনতাই এখন বেশি জরুরী।

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট, সম্পাদক- কিশোর বাংলা এবং পরিচালক (প্রশাসন) ডেইলি অবজারভার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top