অশুভ খেলার পরিকল্পনা আছে বিএনপির: কাদের
বিএনপির মহাসমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ: ফখরুল
বিশেষ প্রতিবেদক ।।
অনেক নাটকীয়তার পর গতকাল ২৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টায় পছন্দের ভেন্যুতেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ২০ শর্তে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবি আদায়ে এক দফার আন্দোলনে আজ শনিবার নয়াপল্টনে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করবে বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে এই মহাসমাবেশ করব। আমাদের মহাসমাবেশের উদ্দেশ্যই হচ্ছে, সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাপ দেওয়া এবং বাধ্য করার চেষ্টা করা।’অন্যদিকে বিএনপি বেলা ২টা থেকে মাগরিবের পূর্ব পর্যন্ত নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে মহাসমাবেশ করবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বক্তব্য রাখবেন বিএনপি স্থায়ী কমিটি সদস্য ও সিনিয়র নেতৃবৃন্দ।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করবে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে। মাত্র দেড় কিলোমিটারের মধ্যে দুই দলের পাল্টাপাল্টি বড় সমাবেশ ঘিরে রাজধানীতে টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি নিয়ে অশুভ খেলার পরিকল্পনা আছে বিএনপির। কেউ যাতে অশান্তি করতে না পারে সেজন্যই আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশের ডাক দিয়েছে। এই সমাবেশটি হবে স্মরণকালের সর্ববৃহত্।’জানা গেছে, আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সমাবেশ করবে। এই সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বক্তব্য দেবেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের এসব সমাবেশে অংশ নিতে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসেছেন। তবে বিএনপির দাবি নেতাকর্মীদের আগমনের পথে পথে তল্লাশি, হয়রানি ও আটকের শিকার হতে হয়েছে।
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, তাদের সমাবেশে ২ লাখ লোক জমায়েত ঘটবে। আর বিএনপি জানিয়েছে তাদের সমাবেশে লোক হবে ১ থেকে সোয়া ১ লাখ। এদিকে জামায়াতে ইসলামীকে সমাবেশের অনুমতি না দিলেও আজ শনিবার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করবে বলে জানিয়েছে দলটি। গতকাল দলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে এই মহাসমাবেশে যোগ দিতে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। এছাড়া বিএনপির যুগপত্ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটগুলোও আজ রাজধানীর ১১টি স্থানে সমাবেশ করবে।
বড় শোডাউন করবে আওয়ামী লীগ: রাজপথে আজ সাংগঠনিক শক্তির শোডাউন দেখাবে আওয়ামী লীগ। বিএনপি ও তার মিত্রদের মহাসমাবেশকে ঘিরে সম্ভাব্য সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ঠেকাতে রাজপথ দখলে নানা কৌশল নিয়েছে দলটি। সকাল থেকে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে পাড়া-মহল্লায় মিছিল করবেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দুপুর ২টায় পূর্বঘোষিত বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে স্মরণকালের সর্ববৃহত্ শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। নেতাকর্মীদের হাতে থাকবে জাতীয় পতাকাসহ মোটা লাঠি। গতকাল থেকেই রাজধানীর চারপাশের সব প্রবেশপথে নেতাকর্মীর সতর্ক পাহারা বসানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগের পক্ষে দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজপথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সতর্ক পাহারায় থাকবেন। শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দেখিয়ে দিতে চায় তারা অশান্তির বিরুদ্ধে। গতকাল শুক্রবার বিকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, আমরা সরকারে আছি, আমরা কেন অশান্তি করব? বিএনপি অশান্তি করতে চায়। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়ে সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে বিএনপি। তারা বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করতে চায়। তাই আমাদের আজ লড়াই করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো সংশয় নেই, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রত্যাশিত অনুকূল পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। সিইসির এ বক্তব্যের বিষয়ে ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চান সাংবাদিকরা। তখন তিনি বলেন, এই বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, আজ বেলা ১১টা থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। মূল সমাবেশ হবে দুপুর আড়াইটায়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) মো. ফারুক খান, শাহজাহান খান, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম প্রমুখ।
লাঠি নিয়ে সমাবেশে আসার নির্দেশ: দলীয় সূত্র জানায়, মঙ্গল ও বুধবার ইউনিট, ওয়ার্ড, থানা, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে চারটি বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এসব বৈঠকে নেতাকর্মীদের ২৪ ঘণ্টা ঐক্যবদ্ধভাবে সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২৮ অক্টোবর লাঠির মাথায় পতাকা নিয়ে মিছিল সহকারে সমাবেশে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের আজ মাঠে থাকার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল।
এদিকে গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আওয়ামী লীগের প্যাড ও স্বাক্ষর জালিয়াতি করে একটি চিহ্নিত মহল ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ স্থগিতের ভুয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। এটা পুরো মিথ্যাচার, গুজব ও অপপ্রচার। সমাবেশ স্থগিত করা হয়নি।
‘বিএনপির মহাসমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ’: বিএনপির আজকের মহাসমাবেশ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ঢাকা মহানগর পুলিশকে চিঠির মধ্য দিয়ে এটা আমরা বলেও দিয়েছি। আমরা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে এই মহাসমাবেশ করব। আমাদের মহাসমাবেশের উদ্দেশ্যই হচ্ছে যে সরকার যেন তার সম্বিত ফিরে পায়, শুভবুদ্ধির ?উদয় হয় এবং তারা একদফা দাবি মেনে নিয়ে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটা নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
মহাসমাবেশের প্রস্তুতি জানাতে গতকাল শুক্রবার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে নয়া পল্টনের কার্যালয়ে সকাল ১১টায় এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন ফখরুল। আজ একাধিক জোট ও দলের কর্মসূচি থাকায় বিএনপি কোনো ধরনের সংঘাতের শঙ্কা করছে কী না প্রশ্ন করলে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা কোনো আশঙ্কা করছি না। আমাদেরটা (মহাসমাবেশ) আমরা করব। প্রশাসনের উদ্দেশে তিনি বলেন, ডিএমপি থেকে এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি পাইনি। আমরা এখনো আশা করব, এ ব্যাপারে তারা কোনো বাধা সৃষ্টি করবেন না। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করছি। যদি সরকার এবং রুলিং পার্টি কোনো রকমের বাড়াবাড়ি করে, অত্যাচার নির্যাতন করে তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। আপনারা বলেছেন, সরকারি দল লাঠির কথা বলেছে। এগুলো উসকানিমূলক। তিনি দেশের মানুষকে মহাসমাবেশে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড.আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আসতে পারে ঘেরাও কর্মসূচি: আজ বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে সরকার পতনের মহাযাত্রা শুরু হবে বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আজকের মহাসমাবেশ থেকে সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, আদালতসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি আসতে পারে। এছাড়া রেলপথ, নৌপথ অবরোধ, ঢাকা অবরোধসহ নিয়মিত নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। এদিকে বিএনপির মহাসমাবেশকে সামনে রেখে দলের কার্যালয়ের সামনের সড়কে গতকাল সারা দিন জড়ো হন হাজারো নেতাকর্মী। জুমার নামাজও পড়েন দলের অফিসের সামনের সড়কে। তাদের উপস্থিতিতে পুরো এলাকায় উত্সবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। নানা কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা রাজধানীতে প্রবেশ করছেন। নয়াপল্টনের সড়কে বিকালে দেখা যায় সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রিকশা মিছিল। তবে সন্ধ্যায় নেতাকর্মীদের পুলিশ এই স্থান থেকে সরিয়ে দেয়। সেখানে মোতায়েন করা হয় রায়ট কার, জলকামান ও সাঁজোয়া যান। নয়াপল্টনে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ।
রাজধানীতে আরো ১১ সমাবেশ আজ: মান্না রবের গণতন্ত্র মঞ্চ বেলা ৩টা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, ১২ দলীয় জোট বেলা ২টায় বিজয় নগর পানির ট্যাংক মোড়ে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বেলা ২টায় পুরানা পল্টন আলরাজী কমপ্লেক্সের সামনে, গণ ফোরাম ও পিপলস পার্টি বেলা ১২টায় মতিঝিল নটর ডেম কলেজের উলটো দিকে গণফোরাম চত্বরে, এলডিপি বেলা ৩টায় কাওরান বাজার এফডিসি সংলগ্ন এলডিপি অফিস সামনে, গণ অধিকার পরিষদ সকাল ১১টায় বিজয় নগর পানির ট্যাংক মোড়ে, এনডিএম বেলা ৩টায় মালিবাগ মোড়ে, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য দুপুর ১২টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, গণ অধিকার পরিষদ (ডক্টর রেজা কিবরিয়া ও ফারুক হাসান) বেলা ৩টায় পুরানা পল্টন কালভার্ট রোডে, লেবার পার্টি বেলা ৪টায় পুরানা পল্টন মোড়ে, এবি পার্টি সকাল ১১টায় বিজয়নগর হোটেল ৭১-এর সামনে, জনতার অধিকার পার্টি বেলা ২টায় বিজয় নগর পানির ট্যাংক মোড়ে, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বেলা ৩টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে এবং জাতীয়তাবাদী পেশাজীবী পরিষদ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আজ সমাবেশ করবে।