রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিভাজন সর্বনাশ ডেকে আনছে

kamal-lohani-samakal-5eedb36fe7268.jpg

কামাল লোহানী – ফাইল ছবি

মেইল ডেস্ক

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী আর নেই। রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থান শনিবার সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

কামাল লোহানীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশিষ্টজনের শোক প্রকাশ করেছেন। গুণী এই সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের ৮৫তম জন্মবার্ষিকীতে ২০১৮ সালের ২৬ জুন তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল একটি দৈনিকে, যেখানে রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে তার ভাবনা এবং তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা অধ্যায়ের কথা উঠে আসে। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।

পত্রিকা: আমরা জানি, পঞ্চাশের দশক থেকেই আপনি একাধারে রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সাংবাদিকতা করেছেন। প্রথমেই জানতে চাই, রাজনীতিতে কীভাবে জড়িত হয়েছিলেন?

কামাল লোহানী: আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়তাম পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। থাকতাম ছোট চাচার বাসায়। তিনি জিলা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মূলত এই সময়েই কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসি এবং সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত হই। পাবনায় ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যেসব তরুণ প্রথম সারিতে ছিল, আমি তাদের মধ্যে ছিলাম। রাজনীতির কারণেই জেলে যেতে হয়েছিল তখন। জেলের মধ্যে বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতাদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাই।

পত্রিকা: কতবার জেলে গিয়েছিলেন?

কামাল লোহানী: চারবার। প্রথমবার ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। দ্বিতীয়বার ১৯৫৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান সেরে পাবনা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদী হাঁটুপানিতে পার হয়ে চাচার বাসায় ফিরছিলাম। সেখান থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তৃতীয়বার জেলে যাই ওই বছরেরই ২৯ মে। যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে গভর্নরস রুল জারি হয় এবং বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়। আমি গ্রেফতার হই সিরাজগঞ্জে গ্রামের বাড়ি থেকে। আমার মনে আছে, পরদিন ছিল ঈদ। উল্লাপাড়া থানায় বসে ঈদের চাঁদ দেখেছিলাম। যখন লোকজন ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছিল, তখন আমাদের নেওয়া হচ্ছিল পাবনা জেলে। আগের তুলনায় সেবার কারাবাস দীর্ঘ ছিল। পরের বছর আগস্টে ছাড়া পাই। আর চতুর্থবার গ্রেফতার হই ঢাকায়; ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণে।

পত্রিকা: পাবনায় আপনাকে প্রথমবার আটকের অভিযোগ কী ছিল? ভাষা আন্দোলন?

কামাল লোহানী: হ্যাঁ, প্রথমবার ভাষা আন্দোলনের কারণে। দ্বিতীয়বারেরটিও ভাষা আন্দোলনের কারণে; কিন্তু বিষয়টি ছিল ইন্টারেস্টিং। পাবনায় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের সভা ছিল। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কনফারেন্স। তার আগের বছর ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি ‘খুনি নূরুল আমীন’ হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছিলেন। আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, ‘নূরুল আমীনের সভা হতে দেব না।’ পাবনার সব স্কুলে ওই দিন আমরা ধর্মঘট ডেকেছিলাম। ছেলেদের স্কুলে এমনিতেই ধর্মঘট হতো। মেয়েদের স্কুলে পিকেটিং করেছিল আমাদের নারী কর্মীরা। তাদের পেছনে সাইকেল নিয়ে আমিও ছিলাম। ওই স্কুলে পড়ত পাবনা জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারির মেয়ে। পাবনায় বিড়ি শ্রমিক, হোসিয়ারি শ্রমিক ও রিকশা শ্রমিকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। তাদের নিয়ে বিরাট মিছিলসহ আমরা সভাস্থলের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন মুসলিম লীগের গুণ্ডারা আমাদের ওপর হামলা চালালে আমরাও পাল্টা হামলা চালাই। শেষ পর্যন্ত সভার মঞ্চ, প্যান্ডেল ভেঙে চুরমার করে দিই। নূরুল আমীন কোনো রকমে নিরাপদে বের হয়ে যান। আমাদের ফেরার পথে মুসলিম লীগের সেক্রেটারির বাড়ি পথে পড়ে। সেই বাড়ির খড়ের গাদায় পিকেটাররা আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বাড়ির ভেতর থেকেও মিছিলে গুলি চালানো হয়। এসব ঘটনা মিলে পরে মামলা করা হয়।

পত্রিকা: আপনি বলছিলেন, এখানে মজার ঘটনা ঘটেছিল। সেটা কী?

কামাল লোহানী: মজার ব্যাপার হলো, এটা কোনো রাজনৈতিক মামলা ছিল না। সাতটি মামলার সবই ছিল ‘ক্রিমিনাল কেস’। এর মধ্যে রেপ কেসও ছিল। ওই মামলা দায়ের করে মুসলিম লীগের সেক্রেটারির মেয়ে নিজে। সে বলে- মেয়েদের স্কুলে পিকেটিংয়ের সময় তাকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা ৬৯ জন আটক হই। টিআই প্যারেডের সময় ওই মেয়ে আমাকে চিহ্নিত করে। কারণ মেয়ে পিকেটারদের পেছনে সাইকেল নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। এতটা খারাপ ছিল মুসলিম লীগ।

পত্রিকা:: চতুর্থবার আটক হয়েছিলেন ঢাকায়। পাবনা থেকে ঢাকা এলেন কীভাবে?

কামাল লোহানী: জেল থেকে বের হয়ে আমার চাচাকে বললাম, আমাকে ১৫ টাকা দিন। তিনি ছিলেন খুব রাশভারি ও কড়া শিক্ষক। আমরা তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতাম না। তিনি বললেন, কী করবে? মাথা নিচু করেই বললাম, ঢাকা যাব। পাবনায় আর থাকব না। তিনি বললেন, পড়াশোনা শেষ না করে কীভাবে যাবে? আমি কোনো কথা বললাম না। তিনি গজগজ করতে করতে মানিব্যাগ থেকে ১৫ টাকা বের করে ছুড়ে দিলেন। আমি পরদিন নগরবাড়ী, গোয়ালন্দ হয়ে নারায়ণগঞ্জে এলাম।

পত্রিকা: নদীপথে?

কামাল লোহানী: হ্যাঁ, তখন নদীপথই ছিল মূল যোগাযোগ ব্যবস্থা। আইজিআরএসএন নামে একটি স্টিমার কোম্পানি ছিল। নারায়ণগঞ্জ এসে খানসাহেব ওসমান আলীর বাসায় উঠলাম। সেখানে বৈঠকখানায় দেখা হলো বর্তমানে খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও খানসাহেবের ছেলে মোস্তফা সারওয়ারের সঙ্গে। তারা আমার বন্ধু ছিলেন। সেখান থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা হলে উঠলাম। প্রথমে ইত্তেফাকের বিজ্ঞাপন বিভাগে, পরে দৈনিক মিল্লাতে শুরু হলো আমার সাংবাদিকতা জীবন।

পত্রিকা: অনেক সংবাদপত্রে কাজ করেছেন আপনি। এখন সেগুলোর নাম বলতে পারবেন?

কামাল লোহানী: অনেক পত্রিকা; সব নাম ঠিক মনেও নেই। তারপরও চেষ্টা করে দেখি। মিল্লাত থেকে অর্ধ-সাপ্তাহিক পাকিস্তান। তারপর সংবাদ, সেখান থেকে দৈনিক আজাদ। আজাদ থেকেই সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণে আটক হই। জেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জেল থেকে বের হয়ে পয়গাম পত্রিকায় যোগ দিই। তারপর পূর্বদেশে কাজ করার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। ভারতে গিয়ে যোগ দিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। মুক্ত স্বদেশে এসে প্রথমে কিছুদিন বাংলাদেশ বেতারে, তারপর দৈনিক জনপদে। জাতীয় চার নেতার একজন কামরুজ্জামান ছিলেন এর প্রকাশক। সেখান থেকে মওলানা ভাসানীর অনুসারী গোলাম কিবরিয়ার দৈনিক বঙ্গবার্তা। নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে সেখানে বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলাম। কিন্তু সাড়ে তিন মাসের মাথায় পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এর পর বাংলার বাণী। ১৯৭৫ সালে পত্রিকাটি বিলুপ্ত করা হলে আমাকে রাজশাহীতে পাঠানো হয় দৈনিক বার্তার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। কিছুদিন পর সম্পাদকের দায়িত্ব নিই। এই সময় আমার মন খারাপ হলো। পেশাগত জীবনে ইউনিয়নের নেতা ছিলাম। সম্পাদকরা ছিল এক ধরনের প্রতিপক্ষ। তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হতো। কিন্তু আমি নিজেই সম্পাদক হয়ে গেলাম!

পত্রিকা: আপনি সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। এখন মিডিয়া অনেক; কিন্তু সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ নয়…

কামাল লোহানী: এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। সাংবাদিকদের এক থাকা উচিত। ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য কে. জি. মুস্তাফা, নির্মল সেন, এবিএম মূসা ও আমিসহ অনেকে আন্তরিক চেষ্টা করেছি।

পত্রিকা: আপনি তো সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। ছায়ানট, ক্রান্তি, গণশিল্পী সংস্থা; সর্বশেষ উদীচীতেও ছিলেন। রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সাংবাদিকতার মধ্যে কোনটা আপনার পছন্দের ছিল?

কামাল লোহানী: পেশাগতভাবে আমি সাংবাদিক ছিলাম। কিন্তু নেশাগতভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। আমি জানতাম ও দেখেছি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন কীভাবে দেশের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, গণসঙ্গীত মানুষকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করত। তবে আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ। একজন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক পরিচয়কেই সবচেয়ে বড় মনে করি। আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বার্তাপ্রধান ছিলাম শুরু থেকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মে এর অনুষ্ঠান আমরা শুরু করেছিলাম নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দিয়ে। আর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের খবর আমি নিজে লেখা, সম্পাদনা ও বেতারে পাঠ করেছিলাম।

পত্রিকা: আপনি পাকিস্তান আমলে ও মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকার কথা বললেন। এখন সাংস্কৃতিক আন্দোলন সেই ভূমিকা রাখতে পারছে না কেন?

কামাল লোহানী: এর কারণ রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে একটা সর্বনাশা বিভাজন ঘটে গেছে। আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংস্কৃতিক শাখা খুবই শক্তিশালী ছিল। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি গোপনে বিভিন্ন নামে তাদের প্রকাশ্য সাংস্কৃতিক শাখা সংগঠিত করত। আমাদের ক্রান্তি ছিল তাই। আবার সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা ছিল স্পষ্ট। ছায়ানট গঠিত হয়েছিল একটি রাজনৈতিক চেতনা সামনে রেখে। এখন সেটা আর নেই। ফলে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর ভূমিকা রাখতে পারছে না। সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোয় সাংস্কৃতিক ভূমিকা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রাজনৈতিক চেতনা ফিরিয়ে আনতেই হবে।

পত্রিকা: আপনার প্রত্যাশা পূরণ হোক। এ লেখা যেদিন ছাপা হবে, সেদিন আপনার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী, আমরা জানি। আপনাকে আমাদের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

কামাল লোহানী: আপনাদের জন্যও শুভ কামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top