ইতিহাস গড়ে ট্রাম্পের জয়, বিশ্বনেতাদের অভিনন্দন

Tramp-NM24.jpg

আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।।

চার বছর আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে নিঃশঙ্কচিত্তে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন খুব কমসংখ্যক মানুষই ভাবতে পেরেছিলেন, তিনি আবারও সদম্ভে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির হাল ধরতে পারবেন।

সেই অসম্ভব কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্প। মঙ্গলবারের নির্বাচনে তাঁর ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। তিনি বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছেন। পাশাপাশি কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে তার দল। নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদেও রিপাবলিকান পার্টি এগিয়ে।

ট্রাম্প ও তার দলের এই চমকপ্রদ জয়ের ফলে মুক্তবিশ্বের নেতার আসনে থাকা দেশটিতে ‘লৌহমানবের’ উত্থানের আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি দেশটি ক্রমাগত ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।

নির্বাচনে ব্যাপক উদ্দীপনা তৈরি করেও ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারেননি। গত আট বছরে দলটি দু’জন নারীকে মনোনয়ন দিলেও তারা কেউই সফলতার মুখ দেখতে পাননি। সমালোচকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা এখনও কোনো নারীকে কমান্ডার ইন চিফের আসনে দেখতে প্রস্তুত নয়। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেমোক্র্যাটরা অদূর ভবিষ্যতে কোনো নারীকে আর মনোনয়ন দেওয়ার সাহস দেখাবে না।

বাংলাদেশ সময় বুধবার সকাল থেকে ফলাফল আসতে শুরু করে। আগে মনে করা হতো, এবার প্রেসিডেন্ট পদে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতে কয়েক দিন লেগে যেতে পারে। তবে রণক্ষেত্র রাজ্য নর্থ ক্যারোলাইনা, জর্জিয়া, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনে জয়ের মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। এর আগেই ফ্লোরিডায় উল্লসিত সমর্থকদের সামনে বিজয়মঞ্চে হাজির হয়ে তাঁর ওয়াচ পার্টিতে দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ‘নজিরবিহীন ম্যান্ডেট’ দিয়েছে। তিনি একটি ‘অসাধারণ বিজয়’ পেয়েছেন।

এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বর্ণযুগ’। তিনি বলেছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের জন্য একটি অসাধারণ বিজয়, যা আবার দেশকে মহান করতে সাহায্য করবে।

ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস পরাজয় স্বীকার করে কোনো বিবৃতি দেননি। সমর্থকদের সামনেও তিনি আসেননি। ট্রাম্পের বিজয় ভাষণের কিছুক্ষণ আগে ওয়াশিংটন ডিসিতে তাঁর নির্বাচনী রাতের পার্টির জায়গায় একদম ভিন্ন দৃশ্য দেখা গেছে। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কমলার বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি বক্তৃতা দেবেন না জানানোর পর উপস্থিত সবাই পরিত্যক্ত চেয়ার আর পতাকা ফেলে বাড়ি ফিরে যান।

অবশ্য পরে জানা যায়, গত রাতে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে তাঁর ভাষণ দেওয়ার কথা। সেখানেই পরাজয় স্বীকার করে নির্বাচিত নতুন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানানোর কথা তাঁর। এর আগে ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলবেন তিনি।

এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে ট্রাম্প ২৭৬টি পেয়ে জয় নিশ্চিত করেছেন। কমলা পেয়েছেন ২২৩টি। জয়ের জন্য প্রয়োজন ২৭০টি। বাকিগুলোর ফল এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ওয়াশিংটন পোস্টের পূর্বাভাস হলো, শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প ৩১২টি আর কমলা ২২৪টি ইলেকটোরাল ভোট পেতে পারেন।

কমলার তুলনায় ট্রাম্প ৫০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছেন। ট্রাম্প ৭ কোটি ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৯টি আর কমলা ৬ কোটি ৬৩ লাখ ৬১ হাজার ৬২৪টি ভোট পেয়েছেন। কমলা ৪৭ শতাংশ আর ট্রাম্প ৫১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

১০০ আসনের সিনেটে ৩৪টিতে ভোট হয় মঙ্গলবার। এতে রিপাবলিকান পার্টির আসন দাঁড়িয়েছে ৫২টিতে। ডেমোক্রেটিক পার্টির আসন নেমেছে ৪২টিতে। ৪৩৫ আসনের প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা ২০৪টি পেয়ে এগিয়ে। ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছেন ১৮২টি। আগের সিনেটে ডেমোক্র্যাট এবং প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। ভোটের চূড়ান্ত ফল পেতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে। তবে জনমত জরিপে ট্রাম্পকে খাটো করে দেখানো হয়েছিল বলে বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। দুই প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হলেও ট্রাম্প বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছেন।

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করবেন। সেদিন থেকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। রীতি অনুযায়ী, ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

তবে তার আগে ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি অনুসরণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হবে। আগামী ১৭ জানুয়ারি ইলেকটোরাল কলেজের প্রতিনিধিরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেবেন।

জয়-পরাজয়ের কারণ
ট্রাম্পের জয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে অভিবাসন ও অর্থনীতি ইস্যু। অভিবাসন ইস্যুতে তিনি ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিলেন। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, এবার সেই কাজ শেষ করবেন বলে মার্কিন নাগরিকদের কথা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর তিনি আইন করে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভোটারদের উদ্বেগও জিতিয়েছে ট্রাম্পকে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররাও অন্য কোনো বিষয়ের চেয়ে অর্থনীতিকেই বেশি আমলে নেন। এবারের নির্বাচনী প্রচারের সময় বিভিন্ন জনমত জরিপে মার্কিন নাগরিকদের প্রায় অর্ধেকই বলেছিলেন, চার বছর আগের তুলনায় এখন তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন। ট্রাম্প প্রতিটি জনসভাতেই প্রশ্ন তুলতেন, চার বছর আগের তুলনায় তারা এখন কি ভালো আছেন? সমর্থকদের ভেতর থেকে জবাব আসত– ‘না’। সুতরাং দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাদের কাকে পছন্দ, তা খুব স্পষ্টই ছিল।

কমলার উপদেষ্টারা বলেছেন, কমলা কখনোই বাইডেনের ব্যর্থতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাননি। তিনি বাইডেনের শাসনেরই পুনরাবৃত্তি করবেন বলে আশঙ্কা ছিল বহু ভোটারের। বাইডেনের বড় ব্যর্থতা ছিল অর্থনীতিতে।

কমলা গত চার বছরের শাসনকাল থেকে নিজেকে পৃথক করতে চাননি। কিন্তু ভোটাররা ইঙ্গিত দিয়েছিল, তারা এটা চেয়েছিল।

ট্রাম্পের হাতে মুক্ত লাগাম
চার বছরের ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রণের পর সিনেট আবার রিপাবলিকানদের হাতে চলে গেল। সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ট্রাম্প ক্ষমতায় বসবেন। ট্রাম্প অনুগত সিনেট মন্ত্রিপরিষদ ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা বাছাইসহ রাজনৈতিক নিয়োগের পথ সহজ করবে। এই নিয়োগে সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন।

রিপাবলিকানরা হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে কিনা, তা নির্ধারণ করতে কয়েক দিন, এমনকি কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে বুধবার সকালের প্রথম দিকেই ট্রাম্প ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তাঁর দল সেখানেও জয়ী হবে।

রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হবে। ফেডারেল আমলাতন্ত্রের পুনর্গঠন করার জন্য ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা রয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে সিনিয়র সরকারি কর্মচারীদের প্রতিস্থাপন করা হবে। তাঁর সমর্থকরা হাজার হাজার অনুগতকে যাচাই করেছে, যারা বিস্তৃত ফেডারেল সরকারের সব দিক নিয়ন্ত্রণ করতে প্রস্তুত।

নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ভোটের প্রচারে ট্রাম্প আমেরিকানদের বলেছিলেন, তিনি ঠিক কী করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহার করবেন। তিনি হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করবেন। তিনি সামরিক ধাঁচের অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ অভিবাসীকে নির্বাসন দেবেন। তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে চূর্ণ করবেন; জনস্বাস্থ্য নিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচারে সরকারকে ব্যবহার করবেন এবং বিদেশে আমেরিকার মিত্রদের ত্যাগ করবেন।

তিনি তাঁর সমালোচকদের শাস্তি দিতে সরকারকে তার নিজের হাতিয়ারে পরিণত করবেন। তিনি তাঁর সমর্থকদের ব্যাপকভাবে পুরস্কৃত করবেন। তিনি এসব করার ম্যান্ডেট চেয়েছিলেন এবং বেশির ভাগ জনগণই তাতে সায় দিয়েছে ব্যালটের মাধ্যমে। তাঁর জয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অনিশ্চয়তার যুগে প্রবেশ করল বলে লিখেছে নিউইয়র্ক টাইমস।

বহু বিতর্ক, তবু বড় জয়
ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। আমেরিকার ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন, তিনি ধারাবাহিকভাবে পর পর দুই মেয়াদে বিজয়ী হতে পারেননি। এর আগে এমন ঘটনা একবারই ঘটেছিল ১৮৯২ সালে। তখন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। কাজেই এবারের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙেছেন ট্রাম্প। ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন।

সিএনএন লিখেছে, ট্রাম্পের বিজয় রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাবর্তন। এতে বিশ্বজুড়ে ধাক্কা লেগেছে। পদে বহাল থাকার জন্য তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে উল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালান। এতে তিনি ওয়াশিংটনে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাওয়ার চার বছর পর দুটি হত্যা প্রচেষ্টা, দু’বার অভিশংসন, ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন তিনি।

এবার পপুলার ভোটেও এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালে ঘাটতি থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় ইলেকটোরাল ভোটের হিসাবে। মঙ্গলবার ভোটাররা যে ভোট দিয়েছেন, তাতে প্রতিটি রাজ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেকটর নির্বাচিত হবেন। আর পুরো দেশের অর্ধেকের বেশি ইলেকটরের সমর্থন বা ইলেকটোরাল ভোট যে প্রার্থী পাবেন, তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতির কারণে মোট ভোটের হিসাবে সারাদেশে বেশি ভোট পেয়েও ইলেকটোরাল ভোটে হেরে যেতে পারেন একজন প্রার্থী। আগের ছয় নির্বাচনের মধ্যে দুটিতে মোট ভোট কম পেয়েও ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ ও ট্রাম্প।

ট্রাম্পকে বিশ্বনেতাদের অভিনন্দন :
ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী ঘোষণার পরই বিশ্বনেতারা একের পর এক তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানানো বিশ্বনেতাদের মধ্যে আছেন– যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top