নীতিমালা উপেক্ষা করে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিনশতাধিক ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার

liverrr.jpg

চিকিৎসা পাওয়ার বদলে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। । ছবি: প্রতীকী

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

বৃহত্তর নোয়াখালীর জেলা শহর মাইজদী, ফেনী ও লক্ষীপুর সদরসহ তিন জেলার সব কয়টি উপজেলা শহরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠেছে তিন শতাধিক হাসপাতাল ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। চিকিৎসা ও ডায়াগনস্টিকের নামে প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছেন হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তারা খাবারের পরিবর্তে ডাক্তারের পরামর্শে নিঃস্ব হচ্ছেন এসব হাসপাতাল ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের লালসার কাছে।

সরকারি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে বৃহত্তর নোয়াখালীর সব সরকারী হাসপাতালের চারপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে এসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই মানহীন। বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চাহিদার ন্যূনতমও বিদ্যমান নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। শুধু তাই নয়, সরকারি হাসপাতাল থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের যে নিয়ম রয়েছে, তার কোনো তোয়াক্কা না করে সরকারী হাসপাতালের সীমানা প্রাচীরসংলগ্ন এলাকা থেকেই গড়ে তোলা হয়েছে এসব বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

এদের অপকর্মের প্রতিবাদ করলে নাজেহাল হতে হয় রোগীর আপনজনদের। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে মূলত সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারদের সিংহভাগ মালিকায় স্থানীয় সরকার দলের নেতাদের পৃষ্ঠ পোষকতায় গড়ে ওঠে এসব হাসপাতাল ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব হাসপাতাল ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রোগী সংগ্রহ করেন সরকারী হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তারাই। সরকারী হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা নাই বলে রোগীর প্রতি মমতা দেখিয়ে উন্নত চিকিৎসার লক্ষে রোগীকে  নির্দিষ্ট বেসরকারী হাসপাতাল ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেন ডাক্তার। রোগী বেসরকারী হাসপাতালে গেলে ডাক্তারদের দুই রকমের লাভ। নগদ লাভ হচ্ছে প্যাথলজজীর কমিশন ৫০-৭০%, আবার শেয়ারের লভাংশতো রয়েছেই।

মূলত সরকারি হাসপাতাল থেকে দালালের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে এনে চিকিৎসার নামে প্রতারণার ব্যবসা করার জন্যই সরকারি হাসপাতালের সন্নিকটে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে তোলা হয়। এসব হাসপাতাল ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাগজপত্র দেখাতে বললে একটি ট্রেড লাইসেন্স দেখিয়ে দেন। বেশির ভাগ হাসপাতাল ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার নির্দিষ্ট ব্যবসার বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেন না। আবার কেউ কেউ স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর মদতে অনুমোদন নিয়েছে (আসল কিনা সন্দেহ আছে) এসব প্রতিষ্ঠান। তাদের মদতেই চিকিৎসাসেবার নামে রমরমা প্রতারণা ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

খোদ  বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও সিভিল সার্জনের নাকের ডগায়, থানার আশেপাশে, উপজেলা প্রশাসনের নিকটেই বিধিবহির্ভূত ও মানহীন এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। কিন্তু এগুলোর তদারকি বা মান নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। ফলে চিকিৎসা পাওয়ার বদলে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

আমি একবার আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করায় তিনি উদ্যোগ নিয়েও ধমে যান। কারন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চেয়ারম্যান বা এমডির পদে বসে আছেন নিজ দলেরই রাগব বোয়ালরা। উল্টো অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সমিতির নেতারা চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে মাথা না ঘামানোর অনুরোধ (হুমকি দেন) করেন।

স্বাস্থ বিভাগের কতৃপক্ষের সূত্রে জানা যায়, সরকারি হাসপাতাল থেকে এক কিলোমিটার বা বিশেষ ক্ষেত্রে আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনের সুযোগ নেই। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের চারপাশে আধা কিলোমিটারের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় ভৌত (কক্ষ) সুবিধা নেই। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। নেই ডিউটি ডাক্তার, ডিপ্লোমা নার্স, টেকনিশিয়ান, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রয়োজনীয় জনবল। ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশও নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। বলতে গেলে প্রয়োজনীয় চাহিদার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান নেই এসব বেসরকারি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তার পরও এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগের নিবন্ধন পেয়েছে, নবায়নও হচ্ছে। আর এর সুবাদে উন্নত চিকিত্সাসেবার নামে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করছে এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান।

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি ক্লিনিকের নিবন্ধন পেতে প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধা, সার্বক্ষণিক ডাক্তার, ডিপ্লোমা নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনারসহ প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ থাকা আবশ্যক। সূত্রমতে, ১০ বেডের একটি ক্লিনিকের অনুমোদনের ক্ষেত্রে শুধু রোগীর ওয়ার্ডের জন্য প্রতি বেডে ৮০ বর্গফুট করে মোট ৮০০ বর্গফুট জায়গা লাগবে। সেই সঙ্গে ওটি রুম, পোস্ট ওপারেটিভ রুম, ওয়াস রুম, ইনস্ট্রুমেন্ট রুম, লেবার রুম, ডক্টরস ডিউটি রুম, নার্সেস ডিউটি রুম, অপেক্ষমাণ কক্ষ, অভ্যর্থনাকক্ষ, অফিস কক্ষ, চেইনঞ্জিং রুম, স্টেরিলাইজার রুম, ভান্ডার রুমসহ সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্তত ১৩টি রুম থাকতে হবে।

এছাড়া পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা প্রয়োজনীয়সংখ্যক টয়লেট, প্রশস্ত সিঁড়ি, জেনারেটরসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে (বিল্ডিং তিনতলার অধিক হলে) লিফটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ওটি রুমে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ওটি টেবিল, পর্যাপ্ত ওটি লাইট, সাকার মেশিন, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, ডায়াথারমি মেশিন, জরুরি ওষুধসমূহের ট্রে, রানিং ওয়াটার, অক্সিজেন, আইপিএসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাধারণ বর্জ্য, ধারালো বর্জ্য, জীবাণুযুক্ত বর্জ্য, তরল বর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও থাকা অত্যাবশ্যকীয়। জনবলকাঠামোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, তিন জন ডিউটি ডাক্তার, ছয় জন ডিপ্লোমা নার্স, প্রয়োজনীয় অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনার থাকতে হবে। কিন্তু এসব নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে ছোট ছোট তিন-চার রুমের বাসাবাড়িতে ক্লিনিক গড়ে তুলে চিকিৎসার নামে প্রতারণা চলছে হরদম।

বৃহত্তর নোয়াখালীর জেলা শহর মাইজদী, ফেনী ও লক্ষীপুর সদরসহ তিন জেলার সব কয়টি উপজেলা শহরেগড়ে ওঠা বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই চাহিদার ন্যূনতমও বিদ্যমান নেই। নেই প্যাথলজিক্যাল স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ। তার পরও এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন পায় কিভাবে। স্বাস্থ্য বিভাগের মদতে গড়ে ওঠা মানহীন এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি হাসপাতাল, রেল স্টেশন, বাস স্ট্যান্ডসহ গ্রামাঞ্চল থেকে দালালের মাধ্যমে রোগী ধরে এনে চিকিৎসাসেবার নামে প্রতারণা করছে প্রতিনিয়ত।

নোয়াখালীর  স্বাস্থ্য বিভাগের এক পরিচালক জানান, এগুলো সরেজমিনে তদন্ত ও পর্যবেক্ষণের সরাসরি দায়িত্ব জেলা সার্জনের ওপর ন্যস্ত। সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলায় একটি করে কমিটি রয়েছে এসব দেখার জন্য। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকেরও কিছু দায় রয়েছে, যা সত্যিকার অর্থে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতার নিরিখে আপস করতে বাধ্য হচ্ছি। অনেক সময় এমন দফতর থেকে ফোন আসে আমরা ইচ্ছা রলেও উপেক্ষা করতে পারি না। যার উপরওয়ালা আছে সে পেলে, অন্যরা পেতে দোষ কোথায়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top