দু’দলের মহাসমাবেশ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা অনিশ্চয়তায় ঢাকাবাসী

ABDD-scaled.jpg

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

আজ দেশের বড় দু’দল বড় দুইটি শোডাউন করবে ঢাকায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে আজ সাংগঠনিক শক্তির শোডাউন দেখাবে।  বিএনপি ও তার মিত্রদের মহাসমাবেশকে ঘিরে সম্ভাব্য সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ঠেকাতে রাজপথ দখলে নানা কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

আজ সকাল থেকে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে পাড়া-মহল্লায় মিছিল করবেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দুপুর ২টায় পূর্বঘোষিত বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে স্মরণকালের সর্ববৃহত্ শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। নেতাকর্মীদের হাতে থাকবে জাতীয় পতাকাসহ মোটা লাঠি। গতকাল থেকেই রাজধানীর চারপাশের সব প্রবেশপথে নেতাকর্মীর সতর্ক পাহারা বসানো হয়েছে।

রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোয় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় অনেকের ব্যাগসহ সঙ্গের জিনিসপত্র তল্লাশি করা হয়। গতকাল সকালে রাজধানীর গাবতলী এলাকায়রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোয় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় অনেকের ব্যাগসহ সঙ্গের জিনিসপত্র তল্লাশি করা হয়। গতকাল সকালে রাজধানীর গাবতলী এলাকায়।

দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হওয়া ২৮ অক্টোবর আজ। বিএনপি মহাসমাবেশ, জামায়াতে ইসলামী সমাবেশ এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আজ শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ সফল করার সব প্রস্তুতি নিয়েছে। চলছে পুলিশের ধরপাকড় ও তল্লাশি অভিযান। সব পক্ষ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার কথা বললেও মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

উদ্বেগ কিছুটা বেড়েছে পুলিশ গতকাল শুক্রবার রাতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে তাদের পছন্দের স্থানে সমাবেশ করার অনুমতি দিলেও জামায়াতকে অনুমতি না দেওয়ায়। এ পরিস্থিতিতে সবার মধ্যে প্রশ্ন—কী হবে আজ? আর বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন, এক দফার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আজ কি নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে?

এদিকে জেলায় জেলায় গ্রেপ্তার অভিযান এবং মহাসড়ক, রাজধানীর প্রবেশমুখসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি সত্ত্বেও ঢাকায় মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। গতকাল বিকেলে এমন কয়েক শ নেতা-কর্মী ভিড় করেছিলেন মহাসমাবেশস্থল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে রাতে আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। পুলিশ বলেছে, যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে তারা প্রস্তুত।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে বেলা দুইটায় বিএনপির মহাসমাবেশ শুরু হবে। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশও শুরু হবে একই সময়ে। এ ছাড়া জামায়াতও একই সময়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ আহ্বান করেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে।

১৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে জনসমাবেশ থেকে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের মাধ্যমে আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলটির নেতারা বলছেন, আজকের মহাসমাবেশ থেকে আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। গ্রেপ্তার ও হয়রানি এড়িয়ে মহাসমাবেশে যোগ দিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিজ দায়িত্বে নিরাপদে ঢাকায় আসার নির্দেশনা দেওয়া আছে। অনেক নেতা-কর্মী ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। অনেকে পথে আছেন।

গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক হাজার নেতা-কর্মী অবস্থান করছেন। তাঁদের বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন। তাঁদের সরে যাওয়ার জন্য দলের পক্ষ থেকে মাইকে বারবার ঘোষণা দেওয়া হলেও তাঁরা সরেননি। নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত সড়কের এক পাশ নেতা-কর্মীদের জটলার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ অনেক নেতা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন।

ডিএমপিকে দেওয়া তথ্যে আজ মহাসমাবেশে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ লোকসমাগমের কথা বলেছে বিএনপি। তবে দলটির নেতাদের আশা, লোকসমাগম আরও অনেক বেশি হবে। তাঁরা বলেন, সমাবেশ সফল করতে দলের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সংঘাতে না জড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ সফল করতে নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ করতে চাই। শান্তিপূর্ণভাবেই এই সরকারের পতন ঘটাতে চাই।’
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আওয়ামী লীগ অশান্তি চায় না। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় ও পরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়। তিনি আজ দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক পাহারায় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সমাবেশ শেষেই চলে না গিয়ে একটু দেখে-শুনে যেতে বলেছেন।

আজকের শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ সামনে রেখে গতকাল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ওই সংবাদ সম্মেলন হয়। এদিকে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ সফল করার পাশাপাশি দলটির নেতাদের কেউ কেউ কর্মীদের লাঠি নিয়েও আসতে বলেছেন। দলীয় সূত্র জানায়, এই সমাবেশে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে দলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সব ইউনিট ছাড়াও সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারা তৎপর রয়েছেন। যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতেও বলা হয়েছে নেতা-কর্মীদের।

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, আজ মহাসমাবেশ থেকে বিএনপির ঢাকায় বসে পড়ার সম্ভাবনা কম। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। দলটি নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সহিংস আচরণ করতে পারে। এ জন্য আগামী দুই সপ্তাহকে রাজনীতির মোড় পরিবর্তনের সময় বলেও মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা। এ জন্য নেতা-কর্মীদের সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, বিএনপি ১০ লাখ লোকের জমায়েতের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি শেষ করলেও সমস্যা নেই। এতে সরকারের ভিত নড়বে না। কিন্তু তারা যদি সহিংস আচরণ করে, সেটা হবে শঙ্কার কারণ। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। তাই নেতা-কর্মীদের আগ বাড়িয়ে কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়াতে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার
মহাসমাবেশ ও সমাবেশ সামনে রেখে রাজধানীতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ডিএমপির সূত্রগুলো বলছে, পুলিশ সদস্যদের ছুটি বাতিল করে মাঠে থাকতে বলা হয়েছে। ২৫ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য দায়িত্বে থাকবেন। সতর্ক থাকলেও মারমুখী ভূমিকায় দেখা যাবে না পুলিশকে। গতকাল বিকেলে নয়াপল্টন পরিদর্শনকালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘থানা-পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় ঢুকবে। এর মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে পারে। এ জন্য আমাদের টহল টিম জোরদার আছে। বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি করা হচ্ছে।’

বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে নয়াপল্টনে ৬০টির বেশি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে ডিএমপি। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্যামেরাগুলো থেকে পাওয়া ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হবে। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, কোনো ধরনের দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলে পুলিশ তা দমন করবে। কোনো দল ঝুঁকি নিলে পুলিশও ঝুঁকি নেবে। সমাবেশস্থলে সিসি ক্যামেরা, ড্রোন থাকবে। গোয়েন্দারা সরাসরি ক্যামেরা নিয়ে মাঠে থাকবেন।

পথে পথে চেকপোস্ট, তল্লাশি
বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গাবতলী, আমিনবাজার, সাভার, আশুলিয়া, তারাব, কাঁচপুর, মদনপুর, পঞ্চবটী, সানারপাড়, সাইনবোর্ড এলাকাসহ ঢাকার সব প্রবেশপথে চেকপোস্ট বসিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব চেকপোস্টে সব ধরনের যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের তল্লাশি এবং জেরা করেন পুলিশ ও র‍্যাব সদস্যরা। পথচারী ও যাত্রীদের কাছে থাকা মোবাইল ফোনও তল্লাশি করা হয়। কাউকে কাউকে চেকপোস্ট থেকে আটকের অভিযোগও পাওয়া গেছে।


কারও কারও মোবাইলের গ্যালারি কিংবা ফেসবুক প্রোফাইলে বিএনপিসংশ্লিষ্ট কিছু আছে কি না, তা দেখা হয়েছে। সাধারণ যাত্রীদের অনেকে ব্যক্তিগত মুঠোফোনের গ্যালারি খুলতে বাধ্য হওয়ায় বিব্রতবোধ করেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ডেও পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়। সেখান থেকে অন্তত ১৫ জনকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) চাইলাউ মারমা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মহাসড়কে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা তৈরির জন্য কোনো পক্ষ যেন অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার বা নাশকতা করতে না পারে, সে জন্য নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

বাস চলাচল কমেছে
মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বাস চলাচল সকাল থেকে কমে যায়। তবে পূর্বঘোষণা ছাড়াই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। তবে পরিবহনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাশকতার আশঙ্কায় বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

রাজধানীসহ সারা দেশে গতকালও গ্রেপ্তার অব্যাহত ছিল। ঢাকায় গতকাল ৬৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বিএনপি দাবি করেছে। টঙ্গীতে আটক করা হয় অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীকে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের আটকের খবর পাওয়া গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top