দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি নোয়াখালীর (জাহাইজ্যার চর) স্বর্ণদ্বীপ

IMG_20200727_151125.jpg

নোয়াখালী থেকে বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির।।

নোয়াখালীর জাহাইজ্যার চর এক সময়ের ডাকাত এবং চরমপন্থীদের অভয়ারণ্য হিসাবে পরিচিতি ছিল। সেই চর আজ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ১৯৯২-৯৬ সালের দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলাচল কারী জাহাজ সমূহ নোয়াখালীর সুবর্ণ চর হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলাচল করতো।  সেই সময়ে নোয়াখালীর মোহনায় কোন এক চরে আটকে পরে একটি বিশাল জাহাজ। পরবর্তীতে জাহাজ আটকে পড়া সেই চরকে নামকরণ করা হয় জাহাইজ্যার চর।

এক সময় মানুষ আতঙ্কে সেই চরের নাম পর্যন্ত নিতো না। সাধারণ মানুষের চলাচল ছিলো না জাহাইজ্যার চরে । এই চরের বিস্তৃত বনভূমি আর গভীর জঙ্গলে গড়ে উঠে বিভিন্ন ডাকাত আর চরমপন্থী দলের আস্তানা৷ কিন্তু কালের স্রোতে বেশিদিন টিকতে পারেনি তারা।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০১৩ সালে সেই চরকে ডাকাত মুক্ত করে। পরে সেনাবাহিনীকে এই চরের উন্নয়নে অনুমতি দেয় বর্তমান সরকার। সেনাবাহিনী এর নতুন নামকরণ করে। যা আজকের নোয়াখালীর স্বর্ণদ্বীপ হিসেবে পরিচিত ৷

এদিকে ব্যবহারের অনুমতি পাওয়ায় ৩৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বিশাল একখণ্ড ভূমি পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
মুল ভূখণ্ড থেকে আলাদা এই ভূমিকে মানুষের বসবাসযোগ্য করে তোলার কাজে নামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই বনভূমি পরিষ্কার করে সেখানে ৬০ হাজার ঝাউ গাছ এবং ভিয়েতনামের ১৫০০ উচ্চ ফলনশীল নারিকেল গাছ রোপণ করে। সেই সাথে বছরের ৮ মাস পানির নিচে তলিয়ে থাকা এই বিস্তৃত জলাভূমিকে উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ধীরে ধীরে উদ্ধার করা হয়েছে মোট জলাভূমির দুই তৃতীয়াংশ জমি। দিনে দিনে ক্রমেই বৃদ্ধি করা হচ্ছে এর আয়তন।
সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন অবকাঠামো।

ইতিমধ্যে সেখানে একটি ৩১ সজ্জা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ দ্বীপের আয়তনকে লাজে লাগিয়ে সেখানে গবাদিপশু খামার স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। যা সেনাবাহিনীর নিজস্ব চাহিদা পূরণে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। সেখানে স্থাপন করা ২০ টি খামারে ১৩ হাজার মহিষ, ১৬ হাজার ভেড়া এবং ৮ হাজার গরু পালন করা হচ্ছে। সেই সাথে এসব গবাদি পশু থেকে প্রাপ্ত দুধ এবং মাংস প্রক্রিয়া জাতকরণের বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে এই দ্বীপে।

দ্বীপে বিভিন্ন ফলের চাষাবাদ শুরু করা হয়েছে। উৎপন্ন করা হচ্ছে বিভিন্ন শাক সবজি। সামাজিক এই সব উদ্যোগের পাশাপাশি দ্বীপকে ঘিরে রয়েছে সেনাবাহিনীর সুবৃহৎ সামরিক পরিকল্পনা।

সেনাবাহিনীর সামরিক পরিকল্পনা অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় এবং উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে এই অঞ্চলকে। যেখানে ইতিমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে সামরিক বাহিনীর বসবাসের জন্য বিশেষ আবাসিক ব্যবস্থা যেখানে একসাথে থাকতে পারবে ৫০০০ সৈন্য। রয়েছে সামরিক মহড়া চালানোর জন্য বিশাল অঞ্চল যা সেনাবাহিনীর ভারি সাজোয়া যান, ট্যাংক এবং আর্মড ক্যারিয়ার বহনে সক্ষম করে গড়ে তোলা হয়েছে। এই অঞ্চলের ভূমি যেখানে বছরের ৮ মাস পানির নিচে থাকতো, সেই ভূমি রক্ষায় ব্যবহার করা হচ্ছে কনক্রিট ড্যাম সেই সাথে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধির কাজ করেছে সেনাবাহিনী। ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের অধীনে থাকা এই বিশাল দ্বীপ টিতে স্থাপন করা হয়েছে টেলিফোন টাওয়ার যা সার্বক্ষণিক মুল ভূখণ্ডের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে সাহায্য করে। রয়েছে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা যেখানে সোলার ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় দ্বীপ টিতে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি তেল ভিত্তিক জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছে।
ঘূর্নিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের মত দুর্যোগে স্থানীয় দের রক্ষা করতে এখানে স্থাপন করা হয়েছে ৩ টি বড় সাইক্লোন সেন্টার। এছাড়াও দ্বীপ টিতে উন্নত ইন্টারনেট সেবা প্রদানে ব্যবহার করা হচ্ছে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সুবিধা। সেনা সদস্যদের জন্য রয়েছে কম্পিউটার ল্যাব।

সামরিক প্রশিক্ষণ হিসেবে গড়ে তুলতে ইতিমধ্যে এই দ্বীপ ঘিরে বাজেট পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সেনাবাহিনী। যার অধীনে দ্বীপটির বিভিন্ন অংশে হেলিপ্যাড নির্মাণ, হেলিকপ্টারের জন্য হ্যাংগার স্থাপন, ট্যাংক প্রশিক্ষণ ট্রাক নির্মাণ, নদী তীরবর্তী এলাকা জুড়ে বনভূমি স্থাপন, ভারি যানবাহন তথা, সেনা পরিবহনে ব্যবহার করা জাহাজ এবং নৌযান জন্য পোর্ট এরিয়া স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

এছাড়া সেনাবাহিনী ভারি যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা সম্বলিত একটি ওয়ার্কশপ এখানে স্থাপন করা হবে। বর্তমানে ৩ টি নৌযান এবং ৬ টি ল্যান্ডিং ক্রাফটের মাধ্যমে এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী।
দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে এই দ্বীপে সামরিক বিমান ওঠা-নামার সুবিধার জন্য এয়ারস্টীপ নির্মাণের পরিকল্পনা যুক্ত করা হয়েছে।

সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সরকারও এই দ্বীপ নিয়ে কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে বিশাল এই ভূমির এক অংশকে সিংগাপুরের আদলে একটি উপশহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে প্রাক যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে ।
এছাড়া এখানে নৌ-বাহিনীর জাহাজ সমূহের জন্য একটি ঘাঁটি নির্মাণ করা হবে। সেনাবাহিনীর তথ্য মতে, এই দ্বীপে প্রতিবছর ১০ হাজার সেনা সদস্য তাদের মহড়া চালাতে সক্ষম। বছরে দুই বার এখানে বর্তমানে বিভিন্ন সামরিক মহড়ার আয়োজন করা হচ্ছে যেখানে দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ডিভিশন থেকে সেনা সদস্যরা যোগ দিচ্ছে। ট্যাংক এবং আর্টিলারি প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি বিমানবাহিনী ছোট পরিসরে বিভিন্ন যৌথ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে।

পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে এই দ্বীপটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় সামরিক প্রশিক্ষণ ঘাটি যেখানে এক সাথে ১০ হাজার এর বেশী সৈন্য মহড়ায় অংশ নিতে পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top