বিক্ষোভ, সংঘর্ষে উত্তাল বাংলাদেশ, নিহত শতাধিক

nm24-5824.png

স্টাফ রিপোর্টার।।

রক্তাক্ত বাংলাদেশ। দায় কার ? রাষ্ট্র না আন্দোলনকারীদের। দায় যার হোক ঝরে গেলো মূল্যবান শতাধীক প্রাণ। এ যেন লাশের মিছিল। নজিরবিহীন গুলি, সংঘাত, সংঘর্ষ। বিভিন্ন সূ্ত্রমতে নিহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। নিহতদের বড় অংশ পুলিশ-আওয়ামীলীগ ও আন্দোলনকারী।

সারা দিনই ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেড়েছে নিহতের সংখ্যা। কখনো ৩৫, কখনো ৪২, কখনো ৫৩, কখনো ৮২, কখনো ৯৬, তাপরও ২/১ করে শতের ঘর পেরিয়েছে। হামলা-সংঘর্ষ হয়েছে জেলায় জেলায়। পুরো দেশই যেন যুদ্ধক্ষেত্র। একই পরিস্থিতি ছিল রাজধানী ঢাকাতেও। পয়েন্টে পয়েন্টে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে ছাত্র-জনতার।

সহিংস হামলায় নিহত হয়েছে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ১৩ পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া কুমিল্লায় আরও এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন শাসকদলের অনেক নেতাকর্মীও। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশ আগে কখনো এমন দিন দেখেনি।

প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে স্থানে স্থানে। প্রত্যেকের হাতেই ছিলো লাঠি, রামদাসহ অন্যান্য দেশীয় অস্ত্রও।  শনিবার আওয়ামী লীগ যখন কর্মসূচি ঘোষণা করে তখন থেকেই নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাতভর সরকার সমর্থকরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন আন্দোলনকারীদের প্রতি। তারই প্রতিফলন দেখা গেছে রবিবার। দিনের শুরুতেই অবশ্য ছাত্র-জনতা শাহবাগের নিয়ন্ত্রণ নেন। এসময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ধাওয়ার মুখে সরে যান।

এরপরও ক্রমশ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ঢাকায়। দেশের বিভিন্নস্থানেও সরকার সমর্থকরা ও আন্দোলনকারীরা একে অন্যের উপর হামলা চালায়। আবার কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশও হামলা চালায়। কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীরাও আওয়ামী লীগের অফিস এবং দলটির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়।

দিনভর শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিস্থিতিতে নতুন করে তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বলবৎ করা হয়েছে কারফিউ। দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে আজ ডাক দেয়া হয়েছে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির। এই কর্মসূচির আওতায় সারা দেশ থেকে আন্দোলনকারীদের রাজধানীতে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিরোধী দলগুলো ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

দিনব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষে আহত হয়েছে কয়েক হাজার। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগই ছিলো গুলিবিদ্ধ। অতিরিক্ত চাপের কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। ঢাকা মেডিকেলে মিনিটে মিনিটে আসে আহত ও নিহতদের বহনকারী এম্বুলেন্স। রাজধানীতে অন্তত ৯ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাশ এসেছে ৭টি। তারা হলেন- কাওরান বাজার এলাকায় গুলিবিদ্ধ কবি নজরুল ইসলাম কলেজের শিক্ষার্থী তাহিদুল ইসলাম (২২), ফার্মগেটে গুলিবিদ্ধ ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রমিজ উদ্দিন (২৮), সায়েন্সল্যাবে গুলিবিদ্ধ হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী (২২), যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ ভ্যানচালক রিয়াজুলদৌল্লা (৩২), টিকাটুলিতে গুলিবিদ্ধ অজ্ঞাত একজন, শাহবাগে গুলিবিদ্ধ অজ্ঞাত একজন।

এ ছাড়াও আরেকজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া মিরপুরে একজন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। মোহাম্মদপুরের বছিলায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ১৯ জেলায় পুলিশসহ অন্তত ৯১ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের গুলিতে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই হলেন শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীও আন্দোলনকারীদের হামলায় নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে সিরাজগঞ্জে ১৩ পুলিশসহ ২৩, লক্ষ্মীপুরে ১০, ফেনীতে ৮, নরসিংদীতে ৬, কিশোরগঞ্জে ৪, মুন্সীগঞ্জে ৪, রংপুরে ৫, সিলেটে ৬, মাগুরায় ৪, পাবনায় ৩, বগুড়ায় ৪, কুমিল্লায় ৪, বরিশালে ২, শেরপুরে ২, ভোলায় ১, জয়পুরহাটে ১, সাভারে ১, হবিগঞ্জে ১, কক্সবাজারে ১ জন ও কেরানীগঞ্জ ১ জন রয়েছেন।

বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনের প্রতিবাদী হাজারো শিক্ষার্থীরা কোটার দাবির পুরনের পর এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি সরকারের পদত্যাগ আন্দোলনে পুলিশ ও সরকারপন্থিদের সাথে ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে রবিবার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল আগেই বলে ছিলো কোটা হলো ইস্যু, আন্দোলনের উদ্দেশ্য অন্য কিছু। এখন সেটাই দৃশ্যমান। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা। রবিবর শিক্ষার্থী ও ঢ়রকার অনুসারী সবাই লাঠি, চাকু, রামদা ও দেশীয় অস্ত্র গুলি চালায়। এতে বহু হতাহত নিহত হয়েছে। অনেক স্থানে ভয়াবহ সংঘাত দেখা দিয়েছে নতুন করে। অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেনি সেনাবাহিনী ও পুলিশ। সাবেক একজন সেনাপ্রধান সেনাদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই আহ্বান সরকারবিরোধী আন্দোলনকে গতি দিয়েছে। ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা সশস্ত্র একটি যানের উপরে উঠে উল্লাস করেন। তারা বাংলাদেশের পতাকা দোলায়।

দুই পক্ষের পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হতে থাকে সরকারী দল ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। রবিবার আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছিলো আগেই। সে হিসেবে সকালে রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় শাহবাগে আসা কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করে ছাত্রলীগ। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুরান ঢাকার দিক থেকে আন্দোলনকারীদের বিশাল একটি মিছিল আসলে ধাওয়া দিতে যায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। কিন্তু উল্টো ধাওয়া খেয়ে পাশে থাকা বিএসএমএমইউতে আশ্রয় নেয় তারা। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। এক পর্যায়ে হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবন ও পার্কিংয়ে থাকা গাড়ি ও এম্বুলেন্সে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা। মুহূর্তে শাহবাগে জড়ো হন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে শাহবাগ, টিএসসি, মৎস্য ভবন, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, কাঁটাবনসহ আশপাশের এলাকা।

পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে ছাত্র-জনতার কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী আসাদ বিন রনি। তিনি বলেন, ছাত্র সমাবেশে বাধা দিতে সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র, গ্রেনেড-বোমা নিয়ে শাহবাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে জড়ো হতে থাকে। তারা ছাত্রদের ওপর হামলা করার পাঁয়তারা করছিল। সাধারণ ছাত্রদের ওপর দায় দিতে তারা পরিকল্পিতভাবে হাসপাতালের ভেতরে আগুন দেয়।

এরপর দুপুরের দিকে বাংলামোটর থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে আওয়ামী লীগ। দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর এক পর্যায়ে পিছু হটে ক্ষমতাসীনরা। ভাঙচুর করা হয় ২১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান আসাদের কার্যালয়। এরপর বাংলামোটর থেকে টিএসসি পর্যন্ত পূর্ণ দখলে নেয় আন্দোলনকারীরা।

একই সময়ে আজিমপুরে হাসিবুর রহমান মানিকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পাল্টা ধাওয়ায় পিছু হটেন তারা। একই সময়ে রাজধানীর উত্তরায়ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। গুলিবিদ্ধরা উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল ও ক্রিসেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সংঘর্ষের সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পুলিশ।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে মোহাম্মদপুরেও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আন্দোলনকারীদের রাবার বুলেট ছুড়ে পুলিশ। এর আগে সকাল থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র হাতে জড়ো হতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বেলা ১২টার পর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা তিন রাস্তার মোড় এলাকা থেকে রাস্তায় নামতে শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা।

বিকাল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মুখোমুখি অবস্থান নিতে শুরু করেন। এর কিছুক্ষণ পরই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশও আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে পুলিশের গুলিবর্ষণ চলে।

রাজধানীর মালিবাগ আবুল হোটেল এলাকায় বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। সরকারবিরোধী নানা স্লোগান আর গ্রাফিতি এঁকে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এ সময় খিলগাঁওয়ের বিভিন্ন রাস্তার গলিতে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ ও সরকার সমর্থিত কর্মীরা।

রামপুরা ব্রিজ থেকে বাড্ডা পর্যন্তও বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় পুরো এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এসময় বনশ্রীতেও সরকারবিরোধী নানা স্লোগান আর গ্রাফিতি এঁকে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

ফার্মগেট এলাকায় গুলিতে আহত একজনকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর ফার্মগেট-কাওরান বাজারে দিনভর হামলায় নিহত ৩ আন্দোলনকারী লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বের করে তাদের নিয়ে রাজপথে নেমেছে আন্দোলনকারীরা। এদিন বিকাল সোয়া ৬টায় আন্দোলনকারীরা শহীদ মিনার থেকে শাহবাগের দিকে স্লোগান দিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় তারা, ‘আমার ভাই মরলো কেন? খুনি হাসিনা জবাব দে’, ছি ছি হাসিনা, লজ্জায় বাঁচি না’, ‘একদফা এক দাবি, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।

দিনভর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখলে রাখে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। সকাল থেকে নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জড়ো হন। এ সময় পাশে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে আগাতে চাইলে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে পুরো এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। তারা খণ্ড খণ্ড ভাগে ভাগ হয়ে গোলাপ শাহ মাজার, পাতাল মার্কেট, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম গেট, ফুলবাড়িয়া বিআরটিসি কাউন্টসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন।

সকাল দশটার পর ধানমণ্ডি-২ নম্বর, সিটি কলেজ, সাইন্সল্যাব এলাকায় জড়ো হতে থাকে ইউল্যাব, স্ট্যামফোর্ড, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, ধানমণ্ডি আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজসহ আশপাশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর মিরপুর-১০ এলাকা। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়া হয়। চার ঘণ্টাব্যাপী চলা সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু হয়। নিহত মিরাজ হোসেন (২২) একটি বাসের চালক। সংঘর্ষে অন্তত তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়ে আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সকাল ১০টার পর থেকেই মিরপুর ১০ গোলচত্বরে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ঢাকা-১৪ আসনের এমপি ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান নিখিলের নেতৃত্বে সেখানে আওয়ামী লীগসহ সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সমাবেশ করেন।

দুপুর ১২টার পর থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিরপুর-১০ নাম্বার এলাকায় আসতে চেষ্টা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ পাওয়া যায়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ, টিয়ারশেল, গুলি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। সংঘর্ষ বেনারশি পল্লী, আইডিয়াল গার্লস স্কুল সড়ক, বিআরটিএ সড়ক, মিরপুর ৬ নম্বর, বেগম রোকেয়া স্মরণীতে ছড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর চিফ মেট্রোপলিটন ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। দুপুরে লাঠিসোটা হাতে আদালতের প্রধান ফটক ভেঙে প্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এরপরই সাময়িকভাবে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের সরকার পদত্যাগের একদফা দাবির সমর্থনে সুপ্রিম কোর্টে প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করছেন আইনজীবীরা। বিক্ষোভ থেকে সরকার পতনের দাবিতে নানান স্লোগান দিয়েছেন আইনজীবীরা। সকাল ১০টা থেকে সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের সামনে আইনজীবীরা বিক্ষোভ শুরু করেন।

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন জুলাইয়ে বেশ কয়েকদিন ভয়াবহ নৈরাজ্যে পরিণত করে। তাতে কমপক্ষে ২০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ক্ষমতার মেয়াদে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী অস্থিরতা।

জুলাইয়ের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেনারা। কিন্তু এই মাসে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ বিপুল পরিমাণে রাস্তায় নেমে আসেন। সরকারকে পঙ্গু করে দিতে তারা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের হাতেই ছিল লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র। তারা ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চল শাহবাগ চত্বরে সমবেত হন। তবে এ শহর এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে রাজপথে সহিংসতা শুরু হয়।

ফলে সন্ধ্যা ৬টা থেকে আবারো দেশ জুড়ে কারফিউ ঘোষণা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিক্ষোভ আয়োজনকারীদের হতাশ করে দিতে আবার মোবাইল ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ করা হয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ জেলায় নিহত হয়েছেন দু’জন যুবক। মৃতদের একজনের মাথায় কোপানো হয়েছে। অন্যজনকে গুলি করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্য এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মুন্সীগঞ্জ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ওদিকে উত্তরের জেলা কিশোরগঞ্জে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে দু’জন। সেখানে বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসীন দলের অফিসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, রংপুর, সিলেট, মাগুরা, কুমিল্লা, বরিশাল, লক্ষ্মীপর এবং ফেনীতে নিহতদের মধ্যে আছে পুলিশ এবং চিকিৎসক।

ছাত্রদের এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তা। সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভুঁইয়া তার ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল করে দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করতে। রবিবার তিনি সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, গুম এবং গণগ্রেপ্তারে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, হতাশ ও বেদনাহত। এই অবস্থা গত তিনটি সপ্তাহ বাংলাদেশকে টালমাটাল করে দিয়েছে। অবিলম্বে রাস্তা থেকে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহারের জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।

জনগণ এখন তাদের জীবন উৎসর্গ করতে আর ভয় পায় না। এসব ভয়াবহতার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার করতে হবে। ওদিকে বর্তমান সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ জামান শনিবার ঢাকায় সেনা সদর দপ্তরে কর্মকর্তাদের বলেছেন, জনগণের আস্থার প্রতীক হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারা সব সময় জনগণের পাশে ছিল। জনগণের কল্যাণে তাই থাকবে এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে পাশে থাকবে। এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হলেও বিস্তারিত আর কিছু বলা হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top