বিশেষ প্রতিনিধি ।।
মনে হচ্ছে নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নে চাল নিয়েও চালবাজী চলছে। পেয়াজ, তৈল, চাল এভাবে কয়েকদিন পরপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাজার লাপাচ্ছে কদের কারসাজিতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যতালিকায় ভাত, পেয়াজ, তৈল ছাড়া চলেই না। প্রতিটি ঘরে প্রতিদিন চাল পেয়াজ, তৈল লাগেই ।
অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবার টার্গেট করেছে চালকে। একদিকে ভরা মৌসুম, অপরদিকে ভারত থেকে আমদানি প্রক্রিয়া চলমান থাকার পরও চালের দাম বৃদ্ধি করে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে সিন্ডিকেট। এতে করে কৃষক ও ভোক্তার পকেট কাটা হচ্ছে।
চালের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে যেসব বিষয় উঠে আসছে, এর মধ্যে রয়েছে মোটা চালকে চিকন চাল করে প্যাকেটজাত অতিরিক্ত মজুত ফুড গ্রেইন লাইসেন্স না থাকা ও মিল মালিকের কারসাজি।
ঢাকার বনশ্রীর একজন চাল বিক্রিতা বলেন, সরকার গোড়ায় গলদ রেখে আমাদের যে জরিমানা করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ অন্যায়। আমরা তো দাম বৃদ্ধি ও কমানোর কাতারে পড়ি না। আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের জরিমানা করাটা সম্পূর্ণ আই ওয়াশ বা মিডিয়া কাভারেজ। চালের দাম বৃদ্ধির গোড়াই ঠিক করতে হবে।
বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে প্রচুর ধান-চাল মজুত থাকার পরও দাম বৃদ্ধিকে দুঃখজনক বলছে ভোক্তা অধিকার পরিষদ। চট্টগ্রাম খাদ্য অধিদপ্তর পাহাড়তলী, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জে একাধিক চাল ব্যবসায়ী নেতা, কৃষক ও ভোক্তার সাথে কথা বলে জানতে পেরেছে, অস্থির চালের বাজারে মূলত গোড়ায় গলদ। মাঝখানে পড়ে ভোক্তা ও কৃষক মরে যাচ্ছে।
চালের দাম বৃদ্ধিতে কৃষক উপকৃত হচ্ছে না। কারণ প্রান্তিক অধিকাংশ কৃষক মিল মালিকদের কাছে জিম্মি। ধান উৎপাদনের পূর্বে মিল মালিকরা কৃষকদের কাছে বিনিয়োগ করেন। কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদন করে অর্থের অভাবে সঠিক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। অধিক লাভবান হন মিল মালিকরা। মিল মালিক, পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা ব্যবসায়ী এবং সর্বশেষ ধাপ ভোক্তাকে অতিরিক্ত দামে চাল কিনতে বাধ্য করছে।
চালের দাম বৃদ্ধিতে খুশি হতে পারেননি কৃষক মফিজ। তিনি বলেন, রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে অনেক কষ্টের বিনিময়ে ধান উৎপাদন করি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিক্রি করার জন্য মিল মালিকের কাছে গেলে কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া যায় না। তবে বাজারে চালের দাম শুনে হতবাক হই। উৎপাদন করি আমরা। লাভবান হন ব্যবসায়ীরা এবং অতিরিক্ত দাম দিতে হয় ভোক্তাকে।
বেসরকারি চাকুরিজীবী পল্টু মিয়া বলেন, সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়াটা এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই নেই। আয় তো বাড়েনি, শুধু বেড়েই চলেছে ব্যয়। চট্টগ্রাম খাদ্য অধিদপ্তরের এক পরিদর্শক বলেন, অতিরিক্ত মজুতদারদের আমরা জরিমানা করেছি এবং তাদের ফুড গ্রেইন লাইসেন্সের আওতায় আসার জন্য নির্দেশ দিয়েছি।
মজুতদারির বিরুদ্ধে অভিযান আরো জোরালো হবে : খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘একটি মহল খাদ্য ঘাটতির বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে তবে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা নেই। মজুতদারির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে এ অভিযান আরো জোরালো হবে।’ গতকাল বৃহস্পতিবার খাদ্যমন্ত্রী বোরো-২০২২ মওসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বাজার মনিটরিং সংক্রান্ত অনলাইন মতবিনিময় সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দুই কারণে সরকার ধান চাল সংগ্রহ করে। প্রথমত, সরকার ধান কিনলে কৃষক তার ফসলের নায্যমূল্য পায়। দ্বিতীয়ত, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।’ বোরো সংগ্রহ সফল করতে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে। কোনো ধরনের গাফিলতি সহ্য করা হবে না।
ধান চাল সংগ্রহকালে কারো সাথে দুর্ব্যবহার না করার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বলেন, তবে চালের কোয়ালিটির সাথে কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। বড় বড় কর্পোরেট হাউজ ধান চাল সংগ্রহ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মিল না থাকলে তারা যেন এ ব্যবসায় যুক্ত না হতে পারে সেটা নিশ্চিতে ধান চালের বাজারে নজরদারি বাড়াতে প্রশাসনকে নির্দেশনা দেন তিনি। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ফুড গ্রেইন লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নে জোর দিতে হবে। কেউ যেন লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা না করতে পারে,অবৈধ মজুত করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন তিনি।
তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চালের দাম ও গমের দাম কমতে শুরু করেছে। সে দেশগুলো চাল ও গম রপ্তানি করবে মর্মে পত্রও দিচ্ছে। বাজার অস্থির করতে দেয়া হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে ট্যাক্স কমিয়ে চাল আমদানি করা হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. মজিবর রহমানের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেন, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জেলা প্রশাসকগণ, কৃষি বিভাগের উপপরিচালক, খাদ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও মিলমালিকরা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
শেষ কথা হচ্ছে, সরকার, মিলমালিক,খুচরা ও পাইকরী বিক্রেতা এমনকি ভোক্তা সবাই সবাইকে দোষই দিচ্ছে। তাদের এই দোষারোপের ফাঁকে পকেট খালি হচ্ছে আম জনতার। ক্রেতার কলিজার উপরে রাখা পকেটটা যতই খালি হচ্ছে ততই ক্ষোভ বাড়ছে সরকারের উপর। তাই সরকারকে ঠিক করতে হবে সিন্ডিকেট বাঁচবে না জনগণ!