করোনায় ব্যবসা নেই, পুঁজিতে হাত ব্যবসায়ীদের দোকান খরচও উঠছে না

dokan.jpg

স্টাফ রিপোর্টার

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে দুই মাস দোকান বন্ধ ছিল রাজধানী ও এর আশপাশের ছোট-বড় শপিংমলের দোকানিদের। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সরকার আরোপিত বিধিনিষেধ মেনে দোকান খোলা হলেও বিক্রি নেই। নিত্যপণ্য বাদে অন্য পণ্যের ক্রেতা এলেও তাতে দোকান খরচ উঠছে না। আবার বিলাসী পণ্যর দোকানে দুই থেকে তিন দিনেও একজন ক্রেতা দেখা যায় না। এমন অবস্থায় চোখে অন্ধকার দেখছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তাই দোকান খোলা রেখেও পুঁজি ভেঙে সংসার চালাতে হচ্ছে তাদের।

এদিকে ব্যতিক্রম দেখা গেছে নিত্য খাদ্যপণ্যর দোকানগুলোতে। করোনার সুযোগ নিয়ে এ খাতের অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন অধিক মুনাফা। ক্রেতারা বলেছেন, করোনাকালে মানবিক হওয়ার পরিবর্তে এই ব্যবসায়ীরা পণ্যের সংকট দেখিয়ে অধিক মুনাফা করছেন। এতে খেটে খাওয়া মানুষরাই মূলত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি তৌফিক এসহান মিডিয়াকে বলেন, আমাদের অবস্থা ভালো না। দিন যত যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা আরো বেশি সংকটে পড়ছে। দোকান বন্ধ থাকা থেকে খোলা রাখা মনে হচ্ছে আরো বেশি যন্ত্রনার হয়ে উঠছে। কারণ বড় যেকোনো মার্কেটে একটি দোকানের দৈনিক খরচ কমপক্ষে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বেচাকেনা হোক বা না হোক এই পরিমাণ খরচ তাদের করতে হচ্ছে। যেটা বন্ধ রাখলে হয়তো অনেক কম হতো। কিন্তু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধও রাখা সম্ভব নয়। আসলেও ব্যবসায়ীরা উভয় সংকটে আছে। এখন পুঁজি ভেঙে খাওয়া ছাড়া পথ নেই। এ অবস্থা আরো বেশি স্থায়ী হলে, অর্থনীতির অবস্থা কোথায় যায় সেটা বলা মুশকিল।

সরেজমিন রাজধানীর পার্শ্ববর্তী বৃহৎ পাইকারি বেচাকেনার হাট টঙ্গী বাজার এলাকায় কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, একমাত্র খাদ্য পণ্যের আড়ত ছাড়া অন্য পণ্যে চলছে মন্দাভাব। ক্রেতা না মিললেও বিক্রেতারা বসে থাকেন পশরা সাজিয়ে। অনেক দোকানে কালেভদ্রে দুই-একজন ক্রেতা এলেও প্রতিযোগিতার কারণে কাঙ্ক্ষিত লাভ হয় না। এটুকুতেও অনেক দোকানদার খুশি। কারণ হিসেবে প্রগতি নামের একটি বড় কাপড়ের দোকানের স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেন বলেন, আমরা গত রোজার ঈদ করতে পারিনি। এবারের বছরটা কীভাবে পার করব সেই চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। দোকান খুলতে ৬ হাজার টাকা খরচ হয়। দিন শেষে এ টাকা বিক্রি করে সবাইকে দিতে পারলেই হয়। এখন ব্যবসার চিন্তা করি না, বেছে থাকতে পারলেই হয়। সকাল ১০টায় খুলে আবার ৪টায় বন্ধ করতে হয়। এটা কেবল খোলা আর বন্ধ করার খেলা বললেও ভুল হবে না।

এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পোশাক, পাদুকা, গৃহস্থালি ও প্লাস্টিক সামগ্রী, মোবাইল, টাইলস ও স্যানিটারি, হার্ডওয়্যার, ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্সসহ সব পণ্যের দোকান খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানে কিছু ক্রেতাও দেখা গেছে। যদিও দোকানিরা জানিয়েছেন, বেচাকেনা কম। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় নিয়ে জীবিকার তাগিদে দোকান খুলতে হয়েছে। সরকারি শর্ত মেনে করোনা প্রতিরোধের সুরক্ষাসামগ্রী কেনা, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন-বোনাস এবং দোকানে পণ্য তুলতে জমানো টাকা খরচ হয়েছে। তাই ক্রেতা পাওয়া না গেলে ব্যবসায়িকভাবে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, এখন দোকানে তো কোনো ক্রেতা নেই। শুধু দোকান-মার্কেট খুলে বসে থাকেন ব্যবসায়ীরা। সব মার্কেটি ক্রেতাশূন্য। মানুষজন খুব সচেতন। করোনা সংক্রমণ বাড়ায় দোকানে ক্রেতাদের উপস্থিতি কম। তাছাড়া মানুষের আয়ে প্রচন্ড আঘাত এসেছে। তাই সহসা ক্রেতা বাড়ার সম্ভাবনা নেই।

করোনা পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চ থেকে লকডাউন ছিল কেরানীগঞ্জ গার্মেন্ট পল্লীতে। ১০ মে থেকে সরকার জনসাধারণের জন্য শপিংমল ও মার্কেটগুলো সীমিত আকারে খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে মার্কেট খুললেও ক্রেতার সংখ্যা কম থাকায় এবং বেচাকেনা না হওয়ায় হতাশায় ভুগছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, সাধারণত রোজার ঈদের মৌসুমকে কেন্দ্র করেই এখানকার সারা বছরের ব্যবসা হয়। অন্যান্য সময় বেচাকেনা তেমন একটা হয় না। তখন ব্যাংক থেকে লোন করে, ধারদেনা করে শোরুম খরচ, স্টাফ বেতন, কারখানা খরচসহ সব খরচ মেটাতে হয়। কম-বেশি প্রায় প্রতি মাসেই লস গুনতে হয় এখানে। কিন্তু রোজার ঈদের আগে দুই মাস ব্যবসা করে সারা বছরের লস মিটিয়ে মুনাফা হত তাদের। গত ২৩ মার্চ থেকে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবার ঈদ মৌসুম ভেস্তে গেছে তাদের। লকডাউন শেষ হলে দোকান খোলার পর ধার-দেনা পরিশোধ করে আবার কীভাবে তারা ব্যবসা করবেন এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ও হতাশায় বেশির ভাগ ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ী নেতা ও কেরানীগঞ্জ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুসলিম ঢালী বলেন, ১০ মে থেকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস পল্লী সীমিত আকারে খোলা হয়। পাইকারি বাজার হওয়ার কারণে সারা দেশ থেকে এখানে পাইকাররা আসেন। কিন্তু যানবাহন বন্ধ থাকায় মফস্বলের কাস্টমাররা কেরানীগঞ্জে আসতে পারেনি। অনেকে কুরিয়ারে মাল নিচ্ছেন। কিন্তু যারা মাল নিচ্ছে তাদের এলাকাও লকডাউন হয়ে গেছে। ফলে উভয়পক্ষ সংকটে পড়েছে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সব নিয়ম মেনেই দোকানদারি করছি। তবে ক্রেতা না থাকায় আমরা সবাই হতাশ। অধিকাংশ ব্যবসায়ীদেরই ব্যাংক লোন নেওয়া আছে। তারা এই সময়টায় বেচাকেনা করে ব্যাংক লোন পরিশোধ করবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের বেতন, প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য খরচ তো আছেই। কিন্তু এখন তো আর তা সম্ভব হচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটা খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top