বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আমরা এখনো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি : চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী

Shek-hasina-NM24.jpg

ওয়াদা করেন ফের নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন: প্রধানমন্ত্রী

চট্টগ্রাম ব্যুরো ।।

চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডসহ আশেপাশের এলাকায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। রোববার দুপুর ২টা থেকে জনসভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল ৯টা থেকে পলোগ্রাউন্ডে জমায়েত শুরু হতে থাকে। ১১টার মধ্যে জনসভার মাঠ পলোগ্রাউন্ড লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছে পুরো বন্দর নগরী। বিশেষ করে, পলোগ্রাউন্ডের আশেপাশে হাজার হাজার নেতাকর্মী অবস্থান করছেন। অনেকে পলোগ্রাউন্ডের সামনে অবস্থান নিয়েছেন।

আওয়ামী সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্যের শুরুতে সকলকে সালাম দিয়ে চট্টগ্রাম ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন, অনেরা ক্যান আছন? বেয়াজ্ঞুন গম আছন নি? তোয়ারার লাই আঁরতে পেট পুরের। এরপর তিনি চট্টগ্রামের প্রয়াত নেতাদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন এবং তাদের রুহের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।

চট্টগ্রাম মহানগরের জনতার জোয়ারকে সামনে রেখে তিনি বলেন, আর যেন কেউ আপনাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে তার জন্য ফের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবেন বলে উপস্থিত সকলের সহযোগিতা ও ওয়াদা চান এবং দুই হাত তুলে উপস্থিত সকলে প্রধানমন্ত্রীকে ওয়াদা দেন। রোববার (৪ নভেম্বর) চট্টগ্রাম নগর উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত জনসভায় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বিকাল ৩ টা ৪৬ মিনিটে বক্তব্য শুরু করে টানা প্রায় এক ঘণ্টা বক্তব্য দেন। এর আগে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে উপস্থিত সকলকের প্রতি হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোঃ মমিনুর রহমানের সঞ্চালনায় বিভিন্ন উন্নয়নে প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর করেন।

এরপর তিনি তাঁর মূল বক্তব্যে ফিরে গিয়ে বলেন, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম লালদীঘির মাঠের জনসভায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে
৩০ জনকে হত্যা করেন এবং হামলা ও হত্যার সাথে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া সম্পৃক্ততা ছিল বলে উল্লেখ করেন। চট্টগ্রামের বহু হিন্দু বৌদ্ধ বিভিন্ন ধর্মালম্বীরা খালেদা জিয়ার হত্যা ও লাশ ঘুমের শিকার হয়েছেন।

সরকার প্রধানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উপস্থিত জনতা সমস্বরে চিৎকার করে ‘ভোট দেব’ বলে ওয়াদা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের জবাবে সবাইকে ধন্যবাদ জানান।তিনি রিজার্ভসহ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়েও কথা বলেন। পাশাপাশি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর চলা অন্যায়-নির্যাতন, বিএনপি-জামায়াতের ‘নানা অপকর্মের’ ফিরিস্ত তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জয় বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ছিল ইতিহাস বিকৃতি আর হত্যা-ক্যুর ষড়যন্ত্র। হাজার হাজার সেনা-বিমানবাহিনীর অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। একেরপর এক ক্যু হয়েছে আর সারারাত কারফিউ-এই ছিল তখনকার অবস্থা। আর এই হত্যাকাণ্ডে ছিল খুনি জিয়া-মোশতাক। বিচার চাওয়ার অধিকার আমার ছিল না। মা-বাবা-ভাই হারিয়েও বিচার চাইতে পারব না! তারপরও সবকিছু মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছি বাংলার জনগণের কাছে। একটাই কারণ-এই জাতির জন্য আমার বাবা সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হয়েই বারবার ক্ষমতায় এসেছি। আর ক্ষমতায় এসেছি বলেই এত উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়েছে। যেখান থেকে বিনা পয়সায় ৩০ ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। আর বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় থাকতে কী দিয়েছিল? দিয়েছে অস্ত্র-খুন-হত্যা। শুধু রক্ত আর হত্যা ছাড়া বিএনপি তো কিছুই দিতে পারেনি দেশের মানুষকে। আর নিজেরা লুটপাট করেছে। নিজেরা মানুষের অর্থ পাচার করেছে। মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। নিজেদের উন্নয়ন করেছে।

বিএনপির কাজই হচ্ছে গুজব ছড়ানো : প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া যখন মারা যায় কোনো কিছু রেখে যায়নি। ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি। কিন্তু সেই ভাঙা স্যুটকেস হয়ে গেল জাদুর বাক্স। যে বাক্স দিয়ে কোকো আর তারেক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। তার শাস্তিও হয়েছে। আজকে তারেক সাজাপ্রাপ্ত আসামি। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করার মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে সাত বছরের জেল আর ২০ কোটি টাকা জরিমানা হয়েছে। অস্ত্র চোরাকারবারি করতে গিয়ে দশ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে ধরা খেয়েছে। সেখানেও সাজা হয়েছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমাকেসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে দিয়ে সাজাপ্রাপ্ত। যে দলের নেতা সাজাপ্রাপ্ত তারা জনগণকে কী দেবে? তারা কিছুই দিতে পারে না। শুধু মানুষের রক্ত চুষে খেতে পারে। এটাই হলো বাস্তবতা। বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, গুজবে কান দেবেন না। বিএনপির কাজই হচ্ছে গুজব ছড়ানো। ওরা নিজেরা তো কিছু করতে পারে না। ক্ষমতায় এসে লুটপাট করে খেয়েছে।

রিজার্ভের কোনো সমস্যা নেই : প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আমরা এখনো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। অনেকেই রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেন। রিজার্ভের কোনো সমস্যা নেই। অনেকে বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা নেই’। ব্যাংক থেকে টাকা তোলেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখলে তো চোরে নিয়ে যাবে। চোরের জন্য সুযোগ করে দেওয়া। ব্যাংকে টাকা নেই কথাটি ঠিক নয়। গতকালও আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমাদের এই বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই। প্রত্যেকটি ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা আছে। আমদের রেমিট্যান্স আসছে। বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ট্যাক্স কালেকশন বেড়েছে। অন্য দেশ যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী আছে।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নয়নশীল দেশ : সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ যাতে পৃথিবীর বুকে সম্মান নিয়ে চলতে পারে সেভাবে দেশের উন্নয়ন করেছি। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নয়নশীল দেশ। সরকার কৃষকের কল্যাণে সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কৃষি উপকরণ কার্ড দিয়েছি। দুই কোটি কৃষক সেই উপকরণ কার্ড পায়। এক কোটি কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। তাদের টাকা তাদের কাছে চলে যায়। ৯০ টাকায় সার কিনে ১৬-১৭ টাকায় আমরা সার দিচ্ছি।

দেশের কোনো মানুষ ঠিকানাবিহীন থাকবে না : বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা চেয়েছিলেন দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। তিনি যে প্রকল্প শুরু করেছিলেন, সেই পথ ধরে সারা দেশে গৃহহীনদের তালিকা করে বিনা পয়সায় জমিসহ ঘর করে দিয়েছি। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ এই ঘর পেয়েছে যাদের কোনো ঠিকানা ছিল না। এটা তাদের জীবন পালটে দিয়েছে, এই দেশের কোনো মানুষ ঠিকানাবিহীন থাকবে না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সময় বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ ভাগ। আমরা এটা ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছি। যে হতদরিদ্র ২৫ ভাগ ছিল তা আমরা ১০ ভাগে নামিয়ে এনেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার সময়ে বাইরে জনসভা করতে পারিনি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। চট্টগ্রাম নগর উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এর সঞ্চালনায় এবং নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক মন্ত্রী চীনের মোশারফ হোসেনসহ কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতারা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো দেশ, এমনকি উন্নত দেশও করোনা ভ্যাকসিন বিনা পয়সায় দেয়নি। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মান সব দেশে টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। আর আমরা ভ্যাকসিন কিনে বিনা পয়সায় আপনাদের দিয়েছি। করোনা মোকাবিলায় বিশেষ বিমান পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিরিঞ্জ, ভ্যাকসিন যা যা দরকার এনেছি। এজন্য কোটি কোটি টাকা আমরা ব্যয় করেছি। অনেকে আমাদের রিজার্ভ নিয়ে কথা বলে যে রিজার্ভ গেল কোথায়। রিজার্ভ কোথাও যায়নি। মানুষের কাজে লেগেছে।

তিনি বলেন, যে গম ২শ ডলারে কিনতাম, তা এখন ৬শ ডলার। তারপর আমরা কিনে এনেছি আমাদের দেশের মানুষের জন্য। গম, ভুট্টা, সার, প্রত্যেকটি জিনিসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে। পরিবহণ খরচ বেড়েছে। তারপরও আমরা কিনে এনেছি যাতে খাদ্য ঘাটতি না দেখা দেয়। এজন্য আমি জমি অনাবাদি না রেখে উৎপাদন করার কথা বলেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top