মৃত্যু বাড়ছে ডেঙ্গুর নতুন ধরনে

dd.jpg

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসকে বলা হয় ডেঙ্গু রোগের মৌসুম। কিন্তু এ বছর জুনের আগেই শুরু হয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। আর বেশি আতঙ্কের কারণ হলো, এ বছর ডেন-থ্রি ভাইরাসে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই বেশি। এতে আক্রান্তরা হেমোরেজে বা সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়েছে। তাই এবার ডেঙ্গুতে মৃত্যুও বেশি। এদিকে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে গেলেও বিষয়টি এখনো স্বস্তির নয় বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বিশ্বে বর্তমানে একশটির বেশি দেশে ডেঙ্গু রোগ হয়। একে ‘সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোগ’ বলে বর্ণনা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সম্প্রতি একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৩৯ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ১২৮টি দেশের ৩৯০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

বাংলাদেশে এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে সর্বমোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ৮৫৭ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৮ হাজার ৬৯০ জন রোগী। ডেঙ্গুতে এ সময়ে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এবার ডেঙ্গুর এ ভয়াবহতার পেছনে দায়ী ডেনভি-থ্রি ভাইরাস। রাজধানীর একটি হাসপাতালের ২০ জন রোগীর নমুনা গবেষণা করে শতভাগ এই ভাইরাস শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর প্রভাব জনমনে বড় ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই না বুঝে জ্বরের কিছু লক্ষণ দেখে অ্যান্টিবায়টিকসহ নানারকম ওষুধ সেবন করছেন। এতে আক্রান্তে শরীরে নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশ কিছু উপসর্গ রয়েছে যা দেখে প্রাথমিকভাবে বোঝা যেতে পারে রোগী ডেঙ্গু রোগে অসুস্থ নাকি করোনায় আক্রান্ত। জ্বর প্রতি ক্ষেত্রেই আসবে। কিন্তু তারতম্য রয়েছে। এজন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন না করার পরামর্শ তাদের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত বাহক অন্য জায়গায় ভ্রমণ করার মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি যখন অন্যত্র ভ্রমণ করেন, সেখানে তাকে এডিস মশা কামড়ালে সেই মশার ভেতরে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। সেসব মশা যাদের কামড়াবে, তাদের শরীরে ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক বিবৃতিতে জানানো হয়, গত একদিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে আরো ২৫২ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকাতেই ২০২ জন এবং ঢাকার বাইরের সারাদেশে রয়েছেন ৫০ জন।

গতকাল রোববার আইএফআরডি অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানে পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ জানান, দেশে ডেনভি-৩ নামে ডেঙ্গু রোগের নতুন একটি ধরন শনাক্ত হয়েছে। রাজধানীবাসী এই ধরনটির মাধ্যমে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আর প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পর আবার ডেঙ্গুর ভিন্ন ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বাড়ে।

অন্যদিকে বিসিএসআইআরের ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান গবেষক ড. সেলিম খান বলেন, রোগীর নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ডেঙ্গুর এই নতুন ধরন শনাক্ত করা হয়েছে। ডেঙ্গুর ৪টি ডেনের মধ্যে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেনভি টাইপ ১ এবং ২ এই দু’টি ছিলো। ২০১৭-এ প্রথম ডেনভি টাইপ-৩ ধরা পড়ে। ২০১৮ সালেও এই ধরনটির বেশ কিছু রোগী পাওয়া যায়। এবার রাজধানীর একটি হাসপাতালের ডেঙ্গু আক্রান্ত ২০ জন রোগীর জিনোম সিকোয়েন্স করে সবার দেহে ডেনভি টাইপ-৩ পাওয়া গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সি বলেন, ২০১৭ সালের আগে ডেনভি-১, ২-তে আক্রান্ত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে অনেকের। কিন্তু ডেনভি-৩ এর বিরুদ্ধে এই ক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। যারা আগের দুই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত তারা নতুন করে ডেনভি-৩ আক্রান্ত হলে হেমোরেজ বা সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়েছে। তাই এবার মৃত্যু বেশি। তিনি আরও বলেন, বিসিএসআইআরের এই সিকোয়েন্সিং ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন উৎপাদনে সহায়ক হবে। এবার ডেঙ্গুর ডেনভি-৩ ভ্যারিয়েন্টে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এটা ডেনভি-১,২ এর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর।

লিখিত বক্তব্যে বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আফতাব আলী শেখ বলেন, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ যা ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ এবং ডেনভি-৪ এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এই ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপের মধ্যে ৬৫-৭০ শতাংশ এমিনো এসিড সিকোয়েন্সের মিল আছে। ভাইরাসটি এডিস মশা দ্বারা বাহিত হয় এবং মশার মাধ্যমে মানবদেহে সংক্রমিত হয়। ১৯৬০ সালে পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

আইইডিসিআরের গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৬ সালের আগে সেরোটাইপ ডেনভি-১ এবং ডেনভি-২ এর মাধ্যমে মহামারি সংঘটিত হয়, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বাকি ২টি সেরোটাইপ শনাক্ত হয়নি। ২০১৭ সালে ডেনভি-৩ প্রথম শনাক্ত হয় এবং ২০১৮ সালে ডেনভি-৩ সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং ২০১৯ সালে এটি মহামারি আকার ধারণ করে। ২০২০ এ পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকলওে এবার ডোঙ্গু পরিস্থিতি আরো ভায়াবহ হতে পারে।

অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে গেলেও বিষয়টি এখনো স্বস্তির না বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল রোববার দুপুরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবদ আমিন এ কথা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমরা অনেকগুলো সংখ্যাতত্ত্ব দেখিয়েছি কিন্তু আমাদের সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বস্তির না। কোভিড-১৯ এর স্টেবল ট্রান্সমিশন যদি বলি, তাহলে পাঁচ শতাংশের নিচে নিয়ে আসতে হবে। এখনো আমাদের সংক্রমণের হার ১৩ শতাংশের বেশি। এই পাঁচ শতাংশে চলে আসার পরও যে একটি দেশ কোভিড-১৯ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে তা বলা যাবে না। একটা সময় আসতে হবে, যখন আমরা বলতে পারবো ২৪ ঘণ্টায় কোনো করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। কোনো মৃত্যু হয়নি। এই অবস্থা যদি আমরা দুই থেকে তিন সপ্তাহ টানা রাখতে পারি, তখন আমরা বলতে পারবো কোভিড-১৯ সম্পূর্ণ রূপে নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি।

সংক্রমণ আবারো বাড়তে পারে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা বলা খুব কঠিন। যে ইনফেকশন হচ্ছে এটি আনপ্রেডিকটেবল একটি ভাইরাস। এটার অনেক ধরনের ভ্যারিয়েন্ট আছে। বাংলাদেশ কিন্তু ইতোমধ্যে সবগুলো ভ্যারিয়েন্ট দেখে ফেলেছে। আলফা, বেটা, গামা, ডেলটা এবং প্রাকৃতিক একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এই ধরনের ভ্যারিয়েন্টগুলো দীর্ঘ সময় থাকে না, দুর্বল হয়ে পড়ে। যে কারণে বর্তমান সময়ে আলফা, বেটা, গামা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা দেখতে পেয়েছি বিভিন্ন দেশে, দুই থেকে তিন মাস ঝড়ের মতো প্রভাব থাকে এরপর ধীরে ধীরে এই ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট কমে যায়। হয়তো বাংলাদেশও সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেটাও বলতে পারছি না নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে আসবে কি না। সম্ভাবনা সব সময় থাকবে। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলি, তাহলে যে কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসুক না কেন সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম থাকবে।

তিনি বলেন, আমরা দেখেছি নিবন্ধন কার্যক্রম সহজ করার পরও অনেকে টিকা নিতে চাচ্ছেন না। বিশেষত সিনিয়র সিটিজেন যারা আছেন আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানিদের টিকা দেওয়ার জন্য নিবন্ধনের ব্যবস্থা যেন আমরা নিজেদের উদ্যোগে করি। টিকা প্রাপ্তির কারণে সবাইকে টিকা দিতে আমাদের অনেক সময় লেগে যাবে। আমাদের দেশে উৎপাদন হচ্ছে বা আমরা যদি অনেক টিকার ব্যবস্থা করতে পারতাম তাহলে অনেক বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া যেত।

আমাদের এখানে হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিস বড় সমস্যা। আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ে যে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে সেখানে এ ধরনের রোগীদের তালিকাভুক্ত করা হয়। পরামর্শ দেওয়া হয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে এসব রোগীদের ওষুধ দেয়। অসংক্রমণ রোগ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে চর্বিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত লবণ, মিষ্টি ও শর্করা জাতীয় খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। তামাক ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হবে, বলেন রোবেদ আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top