মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন : একজন ভালো মানুষের প্রতিকৃতি

117645815_1180316992332086_4080494421673875213_n.jpg

মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন : একজন ভালো মানুষের প্রতিকৃতি। শুধু ফেনী নয়, বাংলাদেশের সচেতন মানুষের কাছে মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন একটি পরিচিত ও সম্মানিত নাম। শেষ বয়সে রাজনীতি করতে গিয়ে প্রথমে সম্মানিত হলেও একটা সময়ে দলের অপশক্তির কাছে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। এটাই হয়তো তাঁর মৃত্যুকে তরান্বিত করেছে।

১৮ আগস্ট মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন এর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালের এ দিন তিনি মৃত্যু বরণ করেন। রাজনৈতিক ও দলীয় কারণে শেষ দিকে অনেকে তাঁকে অপছন্দ করলেও একসময় তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত সততার প্রশ্নে কেউ কখনও কথা তুলেছে কিনা আমার জানা নেই।

অত্যন্ত মৃদুভাষী, সুশিক্ষিত নেহায়েত ভদ্রলোক মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন যখন দলীয় রাজনীতি করতেন না তখন তাঁর কাছ থেকে রাজনীতি বা দল করার জন্য টাকা নেয় নাই এমন কোনো ছোট বা বড়, ডান বা বাম রাজনৈতিক দল ছিলোনা। সংসার চালাতে কষ্ট হতো এমন অনেক রাজনৈতিক নেতা, সমাজ কর্মী ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিকে তিনি নিয়মিত টাকা দিতেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা যারা পরবর্তিতে মন্ত্রী হয়েছেন, তাঁদের অনেকে সকালে নাস্তার আগে তাঁর বাসায় গিয়ে বসে থাকতেন। আর ফেনীর জেলা ও আঞ্চলিক নেতারা, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নিয়মিতভাবে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকতেন।

অত্যন্ত উঁচু মানের দক্ষ সংগঠক ছিলেন মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। তিনি ফেনী সমিতি ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সভাপতি ছিলেন। প্রতিষ্ঠাকালিন ১৯৮৪-‘৮৫ সালে তাঁর বাসা ও অফিস যেনো ফেনী সমিতির অফিস ছিলো। তিনি ফেনী সমিতি ঢাকা ও ঢাকাস্থ ফেনী জেলা ছাত্র সমিতির অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আমি ঢাকাস্থ ফেনী জেলা ছাত্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও ওয়াহিদুর রহমান সভাপতি ছিলেন। মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বৃহত্তর নোয়াখালী সমিতি ঢাকার সভাপতিও ছিলেন দীর্ঘদিন।

বিদেশে পোশাক রপ্তানি ও পোশাক শিল্প উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ও সংগঠক মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন । তিনি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রেও তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠান ছিলো অগ্রণী। শুরুর দিকে বিদেশে বাংলাদেশীদের জন্য অধিক হারে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সমুহের সংগঠন ‘বায়রার’ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন।

এ ছাড়াও মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশে বেসরকারী ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক ও ইসলামি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন।

একাধিক দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। সত্তরের দশকে একটি আধুনিক বিজ্ঞাপনী সংস্থারও মালিক ছিলেন তিনি।

শিক্ষা ক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষকতা করা ছাড়াও তাঁর নিজ এলাকা সোনাগাজীতে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন।

২০১৭ সালে মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেনের স্মরণ সভা জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। মঞ্চে আছেন প্রবীণ সাংবাদিক এরশাদ মজুমদার, খোন্দকার মোজাম্মেল হক, বেলাল মিল্লাত, এম আবদুল্লাহ, লোটন একরাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলাম আমি জিয়া খোন্দকার।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন একজন দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও শীর্ষ ক্রীড়া সংগঠন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের চেয়ারম্যান ছিলেন। তারও আগে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও শীর্ষ ক্রিকেট ক্লাব এ্যাজাক্স-এর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।

মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন সম্ভবত ১৯৯৫ এর শেষ অথবা ১৯৯৬ এর শুরুতে বিএনপিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজনীতি শুরু করেন এবং সভাপতি হিসেবে ফেনী জেলা বিএনপির হাল ধরেন। পরপর তিনবার তিনি ফেনী-৩ সোনাগাজী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তাঁর নিজ আসন সোনাগাজীসহ ফেনীর শতশত বিএনপি নেতা-কর্মী ঢাকা চলে আসে এবং এদের অধিকাংশকেই তিনি পাঁচ বছর ঢাকায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। শোনা যায় গ্রামে অনেকের পরিবারের জন্যেও তিনি নিয়মিত টাকা দিতেন।

২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে। তিনি তখন সংসদ সদস্য ছাড়াও বিএনপি জেলা সভাপতি।ভিপি জয়নাল সাধারণ সম্পাদক। এক পর্যায়ে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এমপি ও জেলা সভাপতি হিসেবে তিনি দলীয় নেতা কর্মীদের অর্থনৈতিক চাহিদা ও সুযোগ সুবিধা পূরণ করতে পারছিলেননা। এ ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থতার কারণ ছিলো, প্রথমত তিনি বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল রাজনীতি রপ্ত করতে পারেননি, দ্বিতীয়ত নীতি নৈতিকতা প্রশ্নেও তিনি সম্ভবত আপোষ করতে পারেননি। পরিণতিতে দলে তাঁর পক্ষে বিপক্ষে গ্রুপিং শুরু হলো, যা এক পর্যায়ে জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রকেও সংক্রমিত করে।

প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেয়া আসনে তখন ফেনী-১ এর এমপি তাঁরই ভাই ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাঈদ এসকান্দার। দলের মধ্যে সৃষ্ট গ্রুপিং তাঁকে আকৃষ্ট করে এবং তিনি একটি পক্ষকে প্রশ্রয় দিয়ে জেলা সভাপতি মোশাররফ হোসেন এমপি ও সাধারণ সম্পাদক ভিপি জয়নাল এমপির বিপক্ষে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে জেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে সাঈদ এসকান্দার জেলা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং আগের সভাপতি মোশাররফ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ভিপি জয়নালকে কমিটির সদস্যও রাখেননি বলে জানা যায়। দলীয় কোনো অনুষ্ঠানে এ দুই নেতাকে ডাকা হতোনা।

এক পর্যায়ে সোনাগাজীর এমপি ও দলের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেনকে তাঁর নিজ এলাকার দলীয় নেতা কর্মীরা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং একাধিকবার তাঁর গাড়ি বহরে দলীয় নেতা কর্মীরা হামলার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে। অনেক দিন তিনি নিজ এলাকায় যেতে পারেননি। পরবর্তীতে গেলেও পুলিশের নিরাপত্তা নিয়ে যেতে হয়েছে।

মৃত্যু বার্ষিকীতে আমরা মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেনকে স্মরণ করছি এবং তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক : জিয়া খন্দকার। রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত ব্যক্তিত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top