যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির কাছ থেকে চীনে তৈরি জাহাজ কিনছে সরকার

balk-jahaj-NM24.jpg

প্রতীকী ছবি

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসির কাছ থেকে দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কিনছে সরকার। জাহাজগুলো কেনা হচ্ছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জন্য। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গতকাল ১২ আগস্ট)  তা অনুমোদনও দিয়েছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের হলেও জাহাজ দুটি নির্মাণ করা হচ্ছে চীনে। সেখান থেকেই পাঠানো হবে বাংলাদেশে।

৫৩ বছর আগে যাত্রা করা রাষ্ট্রায়ত্ত জাহাজ পরিবহন প্রতিষ্ঠান বিএসসির বহরে শুরুর দিকে জাহাজ ছিল কেবল দুটি। এরপর বিভিন্ন সময়ে ৪৪টি যুক্ত হয়। তবে আয়ষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়ায় নব্বইয়ের দশকের শেষে ৩৬টিকেই পাঠানো হয় অবসরে। কমতে কমতে জাহাজের সংখ্যা আবারো দুটিতে নেমে আসে।

২০১৮ সালে চীনের কাছ থেকে কেনা ছয়টি যুক্ত হলে বিএসসির বহরে জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ায় আটটিতে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ইউক্রেনে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে অগ্নিকাণ্ডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ‘এমটি বাংলার জ্যোতি’ ও ‘এমটি বাংলার সৌরভ’। পরে এ দুটি জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। ফলে বর্তমানে বিএসসির বহরে জাহাজের সংখ্যা কমে পাঁচটিতে নেমে এসেছে, যা সংস্থাটির নতুন জাহাজ সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

দুটি জাহাজ কেনার বিষয়টি অনুমোদনের জন্য গতকাল অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।

জানা গেছে, দুটি বাল্ক ক্যারিয়ারের প্রতিটির সক্ষমতা ৫৫-৬৬ হাজার ডিডব্লিউটি। দরপত্র প্রক্রিয়ায় তিনটি প্রতিষ্ঠান দর প্রস্তাব দাখিল করে। এর মধ্যে দুটি প্রস্তাব কারিগরিভাবে রেসপনসিভ বিবেচিত হয়। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির (টিইসি) সুপারিশে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসির কাছ থেকে ৭ কোটি ৬৬ লাখ ৯৮ হাজার ডলারে জাহাজ দুটি কেনার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯৩৫ কোটি ৭১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিএসসির নিজস্ব অর্থায়নেই কেনা হচ্ছে এ জাহাজ।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বিএসসির জন্য আরো তিনটি জাহাজ কেনার বিষয় প্রক্রিয়াধীন। সব মিলিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিএসসির জন্য পাঁচটি জাহাজ কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে আরো ছয়টি জাহাজ কেনার বিষয়েও প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে বিএসসির পর্ষদ।

বিশ্বব্যাপী কভিডের সময়ে জাহাজ ভাড়া এবং এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবার মাসুল ও কমিশন ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। সুবাতাস লাগে জাহাজ পরিবহন কোম্পানিগুলোর ব্যবসার পালে। সে কারণে বছর তিনেক ধরে বিএসসির আয় ও মুনাফা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। ২০২০-২১ হিসাব বছরে প্রতিষ্ঠানটি ২৭৪ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ৭২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল। ২০২৩-২৪ হিসাব বছর শেষে আয় হয়েছে ৪৮৮ কোটি টাকা আর নিট মুনাফা হয় ২৫০ কোটি।

জাহাজের বহর বাড়ানোর মাধ্যমে বিএসসির আয় ও মুনাফা বৃদ্ধির কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগামী পাঁচ বছরে ২২টি জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটির পর্ষদ। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাহাজগুলো কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১৫টি জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়েছে। বাকি সাতটি জাহাজ কিনতে অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধানের জন্য প্রিলিমিনারি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (প্রি-ডিপিপি) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সব সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বিএসসিকে আরো তিনটি জাহাজ কেনার জন্য ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর মধ্যে দুটি বাল্ক কেরিয়ার (৫৫ হাজার ৬৬ হাজার ডিডব্লিউটি) ও একটি এমআর ট্যাংকার (৪৫ হাজার থেকে ৫৫ হাজার ডিডব্লিউটি)। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাহাজগুলো কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিএসসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ডিপিপি প্রণয়ন ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে ঋণ দেয়া হতে পারে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার কোটি টাকার মতো।

বিএসসির জন্য চলতি ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ছয়টি কনটেইনার ভেসেল ক্রয়সংক্রান্ত একটি প্রকল্পে প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইডিসিএফ ও বিএসসির মধ্যে একটি কনসেপ্ট পেপার স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার অধীনে ইডিসিএফ এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করছে। তাদের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকল্পটি সম্পন্ন হবে।

এদিকে চীনা জাহাজের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিএসসির ব্যবসার পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। দেশটির কাছ থেকে নতুন করে আরো চারটি জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। এর মধ্যে দুটি ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংকার ও দুটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার। ব্যয় হবে ২৪ কোটি ১৯ লাখ ২০ হাজার ডলার, যা ঋণ হিসেবে মিলবে চীনের কাছ থেকে।

বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জাহাজ চায়না থেকে আনা হচ্ছে। তবে যে কোম্পানি জাহাজ দুটি সরবরাহ করছে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের। এটি আমাদের জন্য একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। প্রায়ই দেখা যায় যে চীনে তৈরি জাহাজের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন দেয়ার ভয় থাকে। তবে চীনে তৈরি জাহাজের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যদি যুক্তরাষ্ট্রের হয় তাহলে সে ধরনের কোনো ভয় থাকে না। ফলে এটি যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের বন্দরে যেতে পারবে। তাছাড়া সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে আরো তিনটি জাহাজ কিনতে বিএসসিকে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ছয়টি জাহাজ কেনার বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কার্যক্রম চলমান আছে। সব মিলিয়ে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ২২টি জাহাজ কেনার বিষয়ে বিএসসির কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে।’ এসব জাহাজ বহরে যুক্ত হলে সামনে প্রতিষ্ঠানটির আয় ও মুনাফা আরো বাড়বে বলে জানান তিনি।

জাহাজ ব্যবসায় ভালো মুনাফার সম্ভাবনা দেখে ২০২২ সালে পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে বিএসসির পর্ষদে যুক্ত হয় সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি (বেক্সিমকো) লিমিটেড। পর্ষদে বেক্সিমকোর প্রতিনিধি হিসেবে পরিচালকও নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তবে গত বছরের আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সে পরিচালককে বাদ দেয়া হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পুঁজিবাজারে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিএসসির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত বছরের ২৮ অক্টোবর সংস্থাটির শেয়ারের দাম ছিল ৫৬ টাকা। সর্বশেষ গতকাল বিএসসির শেয়ার দর বেড়ে ১১২ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘পুরোপুরি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জাহাজ দুটি কেনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো ঋণ নেয়া হয়নি, বরং বিএসসির নিজস্ব তহবিল থেকেই জাহাজ কেনার টাকা দেয়া হচ্ছে। জাহাজ দুটি অ্যারোডাইনামিক ও ডুয়েল ফুয়েল সম্পন্ন। অন্যান্য জাহাজের তুলনায় এগুলোর গতিও বেশি। বর্তমানে যে জাহাজগুলো রয়েছে সেগুলো পুরনো হয়েছে। এ অবস্থায় বহর বাড়াতে নতুন করে জাহাজ কেনা প্রয়োজন। আরো তিনটি জাহাজ কিনতে সরকার বিএসসিকে ঋণ দেবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্যারিফ নিয়ে সমঝোতার অংশ হিসেবে দেশটির কোম্পানির কাছ থেকে জাহাজ কেনা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা বলেন, ‘ট্যারিফ ঘোষণার আরো আগে থেকেই এ জাহাজ কেনার বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তাই এর সঙ্গে ট্যারিফ ইস্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। যে কোম্পানির কাছ থেকে জাহাজ কেনা হচ্ছে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু জাহাজ দুটি তৈরি করা হচ্ছে চীনের ডকইয়ার্ডে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top