মূল্যস্ফীতি এখনো ৮ শতাংশের ওপরে, মানুষের কষ্ট আরও বাড়ছে
বিশেষ প্রতিবেদক ।।
দেশে বিনিয়োগ খাতে স্থবিরতা কাটছে না। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। সরকারি হিসাবেও উঠে আসছে বেকারত্ব বৃদ্ধির চিত্র। অর্থনীতিতে এক ধরনের বৈপরীত্য তৈরি হয়েছে। একদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ইঙ্গিত মিলছে। অপরদিকে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস শিল্প খাতে স্থবিরতার বার্তা দিচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে স্বস্তি থাকলেও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস ও বিনিয়োগ স্থবিরতা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ কমেছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে নতুন শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি আরও শ্লথ হয়ে পড়বে।
টানা চার বছর ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট ও ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া উদ্যোক্তাদের নিরুত্সাহিত করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। সম্প্রতি এই হার ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এই ধারাবাহিক নিম্নগতি অর্থনীতিতে বিনিয়োগ স্থবিরতার সংকেত দিচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
গত অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। সে লক্ষ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ মাসটিতে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়ে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যেটি আগস্টেও ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময় দেশের খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ খাতের মূল্যস্ফীতি আগের মাসেও ছিল ৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
অর্থাৎ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতে হয়েছিল, গত সেপ্টেম্বরে তা কিনতে হয়েছে ১০৮ টাকা ৩৬ পয়সায়।
আগের বছর একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮০২.৮৭ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর রপ্তানি কমেছে ৪.৬১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে দেশের রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬২৭.৫৮ মিলিয়ন ডলার।
একক মাস হিসেবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের হিসেবে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর এই তিন মাস মিলে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ২৩১ কোটি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস রপ্তানি আয় হয়েছিল ১ হাজার ১৬৫ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি খোলা হয়েছে ২৬ কোটি ৪১ লাখ ডলারের। আগের একই সময়ের তুলনায় যা শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ সুদ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সংকোচনশীল মুদ্রানীতির কারণে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে নিরুত্সাহিত হচ্ছেন। সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসলেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্বস্তি কাটেনি। আর এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, বেকার জনগোষ্ঠী ২৬ লাখ ২০ হাজার। বিবিএসের হিসাবে দেখা যায়, দেশে কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষের তুলনায় শিক্ষিত বেকার বাড়ছে। জরিপ অনুসারে, দেশে যত বেকার আছে, তার মধ্যে সাড়ে ১৩ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী। ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক পাশ। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ জন বেকারের একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী বা উচ্চমাধ্যমিক সনদধারী।
তবে যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তারা সবচেয়ে কম বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, প্রতি বছর ২০-২৪ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। তাদের নিয়ে সরকারি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। যেমন এক বছরে কত ছাত্র পাশ করে বের হবে, কতগুলো নতুন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে; বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কতজন অবসরে যাবে, কতজনের নতুন করে কর্মসংস্থান হবে; কতজনকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে কাজে লাগানো হবে—এসব নিয়ে তেমন কোনো সরকারি পরিকল্পনা নেই। কোনো ডেটাবেজ নেই।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ২০১৬ সালের পর থেকেই কর্মস্থানে স্থবিরতা চলে আসছে। সেখান থেকে এখনো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এছাড়া যাদের কাজ আছে তাদেরও আয় খুব বেশি না। এখানে কাঠামোগত বা পরিবেশগত পরিবর্তন নেই। যেমন কৃষি খাতে কর্মসংস্থান বাড়ছে, এটি আসলে উলটো পথে হাঁটা। বিনিয়োগের চিত্রটি আগে যে জায়গায় ছিল এখনো তেমনি আছে। কিছু কিছু কাজ হয়েছে তবে রূপান্তরমূলক পরিবর্তন হয়নি। দেশের অর্থনীতির পতন কিছুটা হয়তো ঠেকানো গেছে, কিন্তু রক্তক্ষরণ এখনো চলছে। অনেক সংকট দৃশ্যমান যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা, অপ্রতুল রাজস্ব আদায় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারা।
তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো ৮ শতাংশের ওপরে। বাজারে দ্রব্যমূল্য অনেকাংশে বেড়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে। যে আয় তা দিয়ে সংসার চলে না। এছাড়া প্রকৃত মজুরি গত ৪০ মাস ধরে কমেছে। বড় দুর্বলতা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ সংকট। সরকারি বিনিয়োগ তো স্থবিরই, বেসরকারি বিনিয়োগেও কোনো গতি নেই।
ইপিবির তথ্য বলছে, বরাবরের মতোই রপ্তানি আয়ে শীর্ষে রয়েছে পোশাক খাত। তবে গত মাসে পোশাক খাতের রপ্তানি কমে গেছে। যা প্রভাব ফেলেছে সামগ্রিক রপ্তানি আয়ে। গত সেপ্টেম্বরে পোষাক খাত থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ২৮৩ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার। যা ২০২৪ সালের একই সময়ের ছিল ৩০১ কোটি ১ লাখ ১০ হাজার ডলার।
তিন মাসে পোশাক পণ্য রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ৯৯৭ কোটি ৪ লাখ ২০ হাজার ডলার। এর আগের বছর ২০২৪ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে আয় হয়েছে ৯৫১ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার সমপরিমাণ পণ্য।
রপ্তানি আয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কৃষি পণ্য এবং এ খাতেও রপ্তানিতে নেতিবাচক ধারা দেখা গেছে। সেপ্টেম্বর মাসে কৃষি পণ্য রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ১০ কোটি ১৯ লাখ ডলার। যা ২০২৪ সালে ছিল ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ রপ্তানি নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তৃতীয় স্থানে থাকা চামড়া ও চামড়া জাতীয় পণ্যে রপ্তানি বাবদ গত সেপ্টেম্বর মাসে আয় হয়েছে ৯ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৮ কোটি ৭৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার। অর্থাৎ ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রপ্তানি আয়ে চতুর্থ স্থানে থাকা পাট ও পাট জাতীয় পণ্য রপ্তানি বাবদ আয় এসেছে ৭ কোটি ৪৩ লাখ ৩০ হাজার ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের ছিল ৭ কোটি ৫১ লাখ ১০ হাজার ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলায় ১ দশমিক শূণ্য ৪ শতাংশ কমেছে।
পঞ্চম স্থানে রয়েছে গৃহস্থলী পণ্য খাত। এখাতে গত সেপ্টেম্বর মাসে পণ্য রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬ কোটি ৭৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার। অর্থাৎ শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ কমেছে। তবে এই সময়ে প্রিন্টেড মেটারিয়ালস এবং ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোডাক্টস পণ্য রপ্তানি বেড়েছে যথাক্রমে ৫৭.৫০ এবং ৩৬.৪৩ শতাংশ।
