নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে, কিছু জেলায় আবারও বন্যার শঙ্কা

Feni-Bad.jpg

নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকছে পানি । ফাইল ছবি

বিশেষ প্রতিবেদক ।।

নিম্নচাপের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এই ভারী বৃষ্টির কারণে কয়েকটি নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। এতে দেশের নিম্নাঞ্চল বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রামে সাময়িক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কয়েকটি নদীতে আগামী তিন দিনের মধ্যে পানি সতর্কসীমা অতিক্রম করতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের মতে বর্তমানে দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও চট্টগ্রাম বিভাগের মুহুরী, হালদা, গোমতী, ফেনী, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী দুই দিন পর্যন্ত এসব নদীর অববাহিকায় ভারী থেকে অতি ভারী এবং তৃতীয় দিনে মাঝারি-ভারী থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে আগামী তিন দিন পর্যন্ত এসব নদীর পানি আরও বাড়তে পারে। ফেনী জেলার মুহুরী নদী আগামী দুই দিনের মধ্যে সতর্কসীমায় পৌঁছাতে পারে।

সিলেট বিভাগের কংস নদীর পানি বাড়ছে, যাদুকাটা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে এবং সারিগোয়াইন ও সোমেশ্বরী নদীর পানি কিছুটা কমলেও বিপদসীমার নিচেই রয়েছে। এ অববাহিকায় আগামী দুই দিন মাঝারি থেকে ভারী এবং তৃতীয় দিনে মাঝারি-ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে আগামী ৭২ ঘণ্টায় সিলেট জেলার সারিগোয়াইন, সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ও নেত্রকোণার সোমেশ্বরী নদী সতর্কসীমায় প্রবাহিত হতে পারে। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানিও বাড়ছে এবং আগামী তিন দিন পর্যন্ত তা বৃদ্ধি পেতে পারে, যদিও বিপদসীমার নিচেই থাকবে।

এদিকে তিস্তা নদীর পানি বর্তমানে কমছে। আগামী দুই দিন তা স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং তৃতীয় দিনে বাড়লেও বিপদসীমার নিচ দিয়েই প্রবাহিত হবে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে এবং তা দুই দিন স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী তিন দিনে বাড়তে পারে, তবে বিপদসীমার নিচেই থাকবে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানিও হ্রাস পাচ্ছে এবং আগামী পাঁচ দিন পর্যন্ত তা স্থিতিশীল থেকে বিপদসীমার নিচ দিয়েই প্রবাহিত হবে।

বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার উদয় রায়হান জানান, সাগরের সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের অনেক এলাকায় ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এতে করে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এর ফলে ফেনী জেলায় আবারও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলায়ও একই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এদিকে চট্টগ্রাম এলাকায় ভারী বৃষ্টির প্রভাবে সাময়িক বন্যা পরিস্থিতি হতে পারে। তিনি বলেন, ‘টানা বৃষ্টি, নদীর পানি বৃদ্ধি এবং নিম্নচাপজনিত জলোচ্ছ্বাসের কারণে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকায় সাময়িক বন্যা পরিস্থিতির শঙ্কা রয়েছে।’

প্রসঙ্গত, গত ১০ জুলাই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ফেনী জেলার একের পর এক এলাকা প্লাবিত হয়। পরে শহরে পানি ঢুকে শহর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এতে বেশ কয়েকদিন চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ।

সাগরে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপ বর্তমানে ভারতের স্থলভাগে অবস্থান করছে। এর প্রভাবে দেশের ওপর মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টি এবং নদীর তীরবর্তী এলাকায় এক থেকে তিন ফুট বেশি জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা রয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে।

আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপটি পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং এটি আরও পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা ও সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর দিয়ে দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এজন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

অমাবস্যা ও নিম্নচাপের কারণে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ সংলগ্ন দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ১ থেকে ৩ ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

শনিবার (২৬ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর জন্য দেওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার অঞ্চলের ওপর দিয়ে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বদিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টিসহ ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, নিম্নচাপের কেন্দ্রস্থল, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। এর প্রভাবে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। একইসঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

ভারী বৃষ্টিতে চাঁদপুরের মেঘনা উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির উচ্চতা বেড়েছে প্রায় তিন ফুট। এতে ওইসব অঞ্চলের সড়ক, পুকুর ও বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, জোয়ারের সময় মেঘনার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শুক্রবার (২৫ জুলাই) বিকাল থেকে মেঘনার পানির উচ্চতা বেড়েছে। এ সময় চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার নদী উপকূলীয় এলাকায় পানি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও শহর রক্ষা বাঁধের পুরান বাজার এলাকায় নদীর পানি সড়ক সমান অবস্থায় রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহরুল হক বলেন, ‘নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, বিষয়টি আমরা অবগত। আমাদের কর্মকর্তারাও সতর্ক রয়েছেন। তবে মেঘনার পানির উচ্চতা বাড়লেও বেশি সময় স্থায়ী হয় না। শুক্রবার বিকালে জোয়ারের সময় মেঘনার পানি বিপদসীমার পয়েন্ট ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।’

এদিকে বরিশাল বিভাগের পাঁচটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য নদীগুলোর পানির উচ্চতাও বেড়েছে। থেমে থেমে প্রায় সারাদিন বৃষ্টি হয়ে ১ থেকে ৩ ফুট উচ্চতায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের জলানুসন্ধান বিভাগ জানায়, ঝালকাঠির বিষখালী নদীর পানি বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার, ভোলা জেলার সুরমা ও মেঘনা নদীর পানি তজুমদ্দিন উপজেলা পয়েন্টে বিপদসীমার ১ দশমিক ১২ সেন্টিমিটার, দৌলতখান উপজেলা পয়েন্টে ৫০ সেন্টিমিটার, পিরোজপুর জেলার কচা নদীর উমেদপুর পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার ও পিরোজপুরের বলেশ্বর নদীর পানি ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

অন্যদিকে মোংলা উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর, ফলে তিন থেকে চার ফুট উচ্চতার জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে সুন্দরবনের নিচু এলাকাগুলো। শনিবার (২৬ জুলাই) দুপুর থেকে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে সুন্দরবন। এতে হুমকির মুখে পড়েছে বনের বন্যপ্রাণী। সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার থেকে সুন্দরবনের সবচেয়ে উঁচু এলাকা করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রটি জলোচ্ছ্বাসে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে গেছে। তবে এই প্রজনন কেন্দ্রের শেডে থাকা হরিণ, কুমির ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বাটাগুর বাচ্চা কচ্ছপগুলো নিরাপদ রয়েছে বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top