৫ অগাস্ট ২০২৪: শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর জনতার দখলে গণভবন। ছবি: সংগৃহীত
বিশেষ প্রতিবেদক ।।
৫ অগাস্ট ২০২৫ সাল। মঙ্গলবার সাধারণ ছুটি। প্রথম ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উদযাপন করছে বাংলাদেশ। । বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া দিনটির স্মরণে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে নানা আয়োজন।
দিনটি উপলক্ষে এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, “আজ ঐতিহাসিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলে ২০২৪ সালের আজকের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। ঐতিহাসিক এই অর্জনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমি দেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।”
দেশকে ‘স্বৈরাচারমুক্ত করতে গিয়ে’ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সকল শহীদকে ‘গভীর শ্রদ্ধায়’ স্মরণ করেছেন রাষ্ট্রপতি। আহত, পঙ্গুত্ব বরণ করা ও দৃষ্টিশক্তি হারানো সকল বীর জুলাই যোদ্ধার ত্যাগ ও অবদানকে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন।
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও জাতিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অধ্যাপক ইউনূসের ভাষায়, টানা ১৬ বছরের ‘স্বৈরাচারী অপশাসনের’ বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিস্ফোরণ ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থান।
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে দলমত নির্বিশেষে সারাদেশ থেকে হাজারো মানুষ ঢাকার দিকে রওনা দিয়েছেন। উত্তরার দিকে ঢাকার প্রবেশমুখে তখন হাজারো মানুষ রাস্তায়।
হঠাৎ শোনা গেল উত্তরার বাধাগুলো ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী। তখনো যাত্রাবাড়ীতে রীতিমত যুদ্ধ পরিস্থিতি। চানখারপুলে গুলি চালাচ্ছে পুলিশ। এর মধ্যেই এলো সেই খবরটি, ‘শেখ হাসিনা পালিয়েছেন’।
এরপর মুক্তির আনন্দে পথে পথে বাঁধভাঙা উল্লাস। কোথাও আবার নির্বিচারে ভাঙচুর, লুটপাট। গণভবন, সংসদ ভবন আর ওই চত্বরে থাকা সরকারি বাংলোগুলোতে লাখো মানুষের ভিড়। ক্ষমতার চেয়ার উল্টে দেওয়ার আনন্দে শেখ হাসিনার বাড়িতে বসে সেলফি, আইনসভার বেঞ্চে বেঞ্চে বিদ্রোহের রাজ্যপাট।
আনন্দের সঙ্গে ক্ষোভের প্রকাশও ঘটল। থানায় থানায় চলল আক্রমণ, ভাঙচুর, লুটপাট; জ্বলল আগুন। ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্থাপনা যেমন পুড়ল, আক্রান্ত হল কিছু সরকারি স্থাপনাও। দিনভর এদিক ওদিক নানা জায়গা থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া। বাধার মুখে কোথাও ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে পারল না। হঠাৎ পুলিশশূন্য হয়ে পড়া দেশে রাতভর ডাকাত আতঙ্ক। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার অপেক্ষা। বাসাবাড়ি জান মাল রক্ষায় রাতে রাস্তায় নামলো মহল্লাবাসী।
এরপর শুরু হল আরেক অপেক্ষা। কবে হবে নতুন সরকার গঠন হবে। কি নামে সরকার হবে। নির্বাচনই বা কবে হবে? সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল ৮ অগাস্ট। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের আহ্বানে প্যারিস থেকে দেশে ফিরলেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বে দায়িত্ব নিল অন্তর্বর্তী সরকার।
এরপর দাবি উঠল ভোটের আগে হতে হবে বিচার আর সংস্কার। সে উদ্যোগ নেওয়া হল; ঘটনে অঘটনে, প্রত্যাশা আর হুতাশনে কেটে গেল এক বছর।
এক বছর পরে এসে জনতার সেই উত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় বলে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল ‘দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, অপহরণ, ভোটাধিকার হরণসহ সব ধরনের অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে’ তরুণ প্রজন্ম ও আপামর জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
“এই বৈষম্যমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করাই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করে জুলাইয়ের চেতনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।”
“জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র একটি ব্যাপক সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই সংস্কারের মধ্য দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে, প্রকৃত গণতান্ত্রিক উত্তরণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ-আজকের এই দিনে এ আমার একান্ত প্রত্যাশা।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন আজ। এক বছর আগে এই দিনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পূর্ণতা পায়, দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, যাদের যূথবদ্ধ আন্দোলনের ফসল আমাদের এই ঐতিহাসিক অর্জন, তাদের সবাইকে আমি এই দিনে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
“আজ আমি স্মরণ করছি সেই সব সাহসী তরুণ, শ্রমিক, দিনমজুর ও পেশাজীবীদের, যারা ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে শাহাদত বরণ করেছেন। আমি গণ-অভ্যুত্থানে শাহাদত বরণকারী সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। আমি গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি সকল জুলাই যোদ্ধাকে যারা আহত হয়েছেন, চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। জাতি তাদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।”
“জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে যে সংস্কার কার্যক্রম নিয়েছে, বাণীতে তা তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেছেন, জুলাই শহীদদের স্মৃতি রক্ষা ও আহত জুলাই যোদ্ধাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে রাজনৈতিক ও নির্বাচন ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় সকল সংস্কারে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা চলমান আছে।
“একটি টেকসই রাজনৈতিক সমাধানের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ,” বলেন অধ্যাপক ইউনূস।
তিনি বলেন, “জুলাই আমাদের নতুন করে আশার আলো- একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।”
জাতিকে সতর্ক করে তিনি বলেন, “পতিত স্বৈরাচার ও তার স্বার্থলোভী গোষ্ঠী এখনও দেশকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হবে। আসুন সবাই মিলে আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না।”
যে পথ ধরে ৩৬ জুলাই
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা ছিল। তবে এর হার ও ধরন বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে।
২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ পদে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত ছিল।
ওই বছর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করা হয়। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতই বহাল রেখে জারি করা পরিপত্র।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন।
গত ৫ জুন সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট।
ওইদিনই রায় প্রত্যাখান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখান শিক্ষার্থীরা। এরপর ৯ জুন হাই কোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫ জুন পরবর্তী ৬১ দিনের মধ্যে প্রথম ৪০ দিন দেশের নানা জায়গায় আন্দোলন হলেও জুলাইয়ের মাঝামাঝি মধ্য জুলাইয়ে ছাত্রদের লক্ষ্য করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলির মুখে এই আন্দোলনে যুক্ত হন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, এমনকি চাকরিজীবীরা।
আন্দোলন রূপ নেয় এক দফায়– শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ।
সংঘাত আর রক্তপাতের মধ্যে জুলাই পেরিয়ে আন্দোলন প্রবেশ করে অগাস্টে। তবে আন্দোলনকারীরা বলে ওঠেন, তাদের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস শেষ হবে না। তারা গুনতে থাকেন ৩১ জুলাই, ৩২ জুলাই…। হাজারো মৃত্যু আর রক্ত পেরিয়ে অবশেষে জুলাই মাস শেষ হয় ‘৩৬ দিনে’।
১৫ বছর ধরে বাংলদেশের শাসন ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। শুরু হয় শেখ হাসিনাবিহীন এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা।
জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের যে তালিকা সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে, সেখানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৪।
তবে অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘ যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হতে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে।
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি নিয়ে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যা ও নির্বিচার গুলির একাধিক বড় অভিযান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও তদারকিতে হয়েছিল।
“সংগৃহীত সব তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং মুক্তভাবে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআরের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে যে সাবেক সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয়ে সহিংস উপায়গুলো ব্যবহার করে পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িয়ে পড়ে। এ কারণে, শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বলপ্রয়োগ করা হয়। নির্বিচারে আটক, এবং নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিগ্রহের ঘটনা ঘটে।
“অধিকন্তু ওএইচএসিএইচআর যৌক্তিক কারণে মনে করে যে বিক্ষোভ এবং ভিন্নমত দমনের কৌশল হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের অবগতি, সমন্বয় এবং নির্দেশনায় পরিচালিত হয়েছে।”
কেমন গেল এক বছর?
রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের পর পেরিয়ে গেছে একটি বছর। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, “পতিত স্বৈরাচার বাংলাদেশকে যেভাবে ধ্বংসস্তূপ বানিয়েছে সেখান থেকে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হলে ন্যূনতম তিনটি আবশ্যিক কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
“প্রথমত, বিচার ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দৃশ্যমান করে তোলা। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুর্নগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার সাধনে প্রয়োজনীয় ঐক্যমত ও পথনকশা তৈরি করা। তৃতীয়ত, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এ লক্ষ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে সংস্কার করা।”
তিনি বলেন, “এই তিনটি ম্যান্ডেট হচ্ছে দেশবাসীর সাথে আমাদের চুক্তি। চব্বিশের শহীদের রক্তেভেজা এই চুক্তি আপনাদের সার্বিক সমর্থন, আস্থা ও সহযোগিতা নিয়ে এবং পতিত শক্তি ও তার দোসরদের সৃষ্ট সকল বাধা-বিপত্তিকে পরাভূত করে আমরা সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
এর মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিচার শুরু হয়েছে। তাদের মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
এছাড়া চানখারপুল এলাকায় হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠন হয়েছে। রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা মামলা অভিযোগ গঠনের শুনানির পর আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে। আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর মামলাটি অভিযোগ গঠনের শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
প্লট দুর্নীতি মামলায় শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তানদের বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছে জজ আদালত।
জুলাই আন্দোলনে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হামলার নির্দেশ ও জড়িত থাকার অভিযোগে দেশজুড়ে সহস্রাধিক মামলা হয়েছে। কেবল ঢাকাতেই আন্দোলনকেন্দ্রিক মামলা হয়েছে ৬৬৮টি।
বেশিরভাগ মামলার আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ অনেকেই এখন নাগালের বাইরে। শেখ হাসিনা অবস্থান করছেন ভারতে। তাকে ফেরত পাঠাতে অন্তর্বর্তী সরকারের অনুরোধে সাড়া দেয়নি ভারত।
জুলাই অভ্যুত্থান রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল, তাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে তিন ডজন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সাড়ে পাঁচ মাস ধরে আলোচনার পর একটি উপসংহারে পৌঁছেছে জাতীয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশগুলোর মধ্যে ৮১টি বিষয়ে দলগুলোর একমত হওয়ার কথা ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
আগামী নির্বাচনের পর নতুন সরকারে যেই আসুক, ঐকমত্য হওয়া সেসব সংস্কার বাস্তবায়ন করতে লিখিত অঙ্গীকার করবে দলগুলো। সেই অঙ্গীকারনামা যুক্ত করে মঙ্গলবার অভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে জুলাই সনদ প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে।
জুন মাসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তবে ১৩ জুন লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠকের পর সরকারের তরফে বলা হয়, সব প্রস্তুতি শেষ হলে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হতে পারে।
নির্বাচন কমিশনও এখন ফেব্রুয়ারি মাথায় রেখে সব প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার কথা বলছে। সেই নির্বাচনের তারিখ কয়েক দিনের মধ্যেই ঘোষণা করা হতে পারে বলে আভাস দিয়ে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টার মুখপাত্র।
কিন্তু গত বছর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যাদের ৩৬ জুলাই উদযাপন করতে দেখা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে এখন ভাঙনের সুর। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল, অংশ নিয়েছিল, অনেকের সেই আকাঙ্ক্ষাও হোঁচট খেয়েছে, মনে ভিড় করেছে হতাশা।
চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি গত কয়েক মাসে কিছুটা কমলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসেনি। আইন-শৃঙ্খলা, জীবিকা নিয়ে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা ও উদ্বেগ বেড়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এক বছর আগে “যে সরকার বৈষম্য দূর করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসছে, তাদের একটা পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা রয়েছে। মব সন্ত্রাস বলি, নারীদের ওপর নিপীড়ন, শ্রমিকদের ওপর যে আক্রমণ হচ্ছে সে বিষয়ে সরকারের ভূমিকা সন্তোষজনক না। ন্যায্য কথা বললে দমন-পীড়ন হচ্ছে, কিন্তু মব সন্ত্রাসীদের বেলায় সরকারে নমনীয়তা রয়েছে। এগুলো সমস্যা তৈরি করছে।” এখনো সেই একই সংস্কৃতি বহাল রয়েছে, শুধু কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। কার্যত কোনো পরিবর্তন নেই।
“মানুষের কথা, তাদের জীবনমানের উন্নয়নের কথা কেউ বলছে না। খালি শেখ হাসিনা ও তার বন্দনাকারীরা এখন দৃশ্যপটে নেই, পার্থক্য বলতে এইটুকুই।”
তাদের মতে, “স্বৈরাচারী সরকার দিনে দিনে গড়ে উঠা–এটা তো সকলের সামনেই হয়েছে, যখন দেখেছে এই স্বৈরাচারী সরকার হটানোর সুযোগ এসেছে, পতন ঘটানো সম্ভব, তখন কিন্তু যে যার অবস্থান থেকে… ফুচকাওয়ালা থেকে রিকশাওয়ালা, একজন দিনমুজুর,অভিনয়শিল্পী সকলেই গিয়েছে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হবে এই আকাঙ্ক্ষা থেকে।”
এই উপসংহারে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যেভাবে মব কালচার তৈরি হচ্ছে, নারী বিদ্বেষী সভা সম্মেলন হচ্ছে, নারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে, গণহারে হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে, মাজার ভাঙা হচ্ছে, ভাস্কর্য ভাঙা হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় নাটক, সিনেমা প্রচারে ঝামেলা তৈরি হচ্ছে–এগুলো তো আমরা আশা করিনি। সরকার ব্যর্থ হচ্ছে বলেই এ জিনিসগুলো মানুষের সামনে চলে আসছে।
আমরা জাতিগতভাবে খুবই দুর্নীতিগ্রস্থ, খুবই অসৎ ধরনের মানুষ। তারা হয়ত চেষ্টা করেছেন কিন্তু খুব একটা কাজে লাগাতে পারেননি। দৃশ্যমান কোনোরকম ফলাফল আমি দেখিনি। যতটুকু দেখেছি ততটুকুতে আমি হতাশ।”
জকের দিনভর আয়োজন
অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি ঘিরে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে থাকছে দিনব্যাপী আয়োজন।
সেখানেই বিকাল ৫টায় ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ উপস্থাপন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশ টেলিভিশন অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে। বেলা ১১টা থেকে বিভিন্ন শিল্পী গোষ্ঠীর গানে শুরু হবে আয়োজন। বেলা ২টা ২৫ মিনিটে থাকবে ‘ফ্যাসিস্ট এর পলায়ন উদযাপন’। এরপর ফের গান; ৫টায় ঘোষণাপত্র উপস্থাপন; ৭টা ৩০ মিনিট থেকে ‘স্পেশাল ড্রোন ড্রামা’ এবং ৮টায় হবে কনসার্ট। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমি ও সংসদ সচিবালয় মিলে যৌথভাবে এসব আয়োজন করবে।
এ আয়োজনের কারণে আজ মঙ্গলবার ঢাকাবাসীকে মানিক মিয়া এভিনিউ এবং আশপাশের সড়ক এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
জামায়াতে ইসলামী এদিন দেশব্যাপী গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতিতে দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ গণমিছিল সফল করতে দেশের সব মহানগরী ও জেলা শাখার নেতাকর্মীদেরআহ্বান জানিয়েছেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দিনটি উদযাপন করবে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবে। সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে শুরু হবে দিনভর আয়োজন। সেখানে সমাবেশের পাশাপাশি দুপুর গণমিছিল নিয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদিক্ষণ করবেন নেতাকর্মীরা।
দুপুর আড়াইটায় শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলবে মাগরিবের আগ পর্যন্ত। মাগরিবের পরে মাহফিল ও দোয়ার কার্যক্রম শুরু হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি ঘিরে বিএনপি ৩৬ দিনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। তবে ৫ অগাস্ট সরকারি কর্মসূচি থাকায় বিএনপি কোনো কর্মসূচি রাখেনি। পবে বুধবার ঢাকাসহ সারাদেশে ‘ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল’ হবে।
তবে আজ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠনের নিজস্ব কোন কর্মসূচি নেই। তবে তারা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে অংশ নেবেন।