বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুতে মালিকানার সীমা উন্মুক্ত চায় যুক্তরাষ্ট্র

a377ca997551a583baf50d7d9139c610-57f1172ec21bd.jpg

কূটনৈতিক প্রতিবেদক ।

সম্প্রতি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ওয়াশিংটনে। এতে দুই দেশের মধ্যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি কেমন হবে, সেসব বিষয়ে যুক্তিতর্ক হয়েছে। বেশ কিছু বিষয়ে দুই দেশ মোটামুটি একমত হলও কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। শুল্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নায্যতা প্রত্যাশা করে। ফলে এই বিষয় নিয়ে আবারও দুই দেশ আলোচনায় বসবে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের বাধার অবসান চায় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি চাইছে তেল, গ্যাস, বীমা ও টেলিযোগাযোগ খাতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার যে সীমা আছে, তাদের ক্ষেত্রে যেন তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। ঢাকার সঙ্গে শুল্কের দরকষাকষিতে এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছে ওয়াশিংটন। ঢাকা ও ওয়াশিংটন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এ শর্ত নিয়ে জানতে চাইলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে নোয়াখালী মেইলকে বলেন, তেল, গ্যাস ও টেলিযোগাযোগ খাত যে কোনো দেশের জন্য সংবেদনশীল। এসব খাতের কিছু অংশ সরকার নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখে। যদি মার্কিন কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ চলে যায়, সে ক্ষেত্রে কৌশলগত ঝুঁকি থাকে।

আজ হয়তো শুল্ক বাড়িয়ে দাবি আদায়ে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র। তখন হয়তো সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে দাবি আদায় করবে। যে পণ্য ও সেবাগুলো পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, এমন পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এখনও আলোচনার মধ্যে রয়েছে।

একটি দেশ, অন্য দেশকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। শুল্ক বাড়িয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন জোরজবরদস্তি করে সুবিধা করার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা। একদিকে শুল্ক বাড়িয়ে চাপে ফেলে, অন্যদিকে বাড়তি সুবিধা চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশে মার্কিন প্রতিষ্ঠান শেভরন এখনও মাগুরছড়ার ক্ষতিপূরণ দেয়নি। এগুলো নিয়ে সরকারের আরও সোচ্চার হওয়া উচিত। সরকার যদি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের পাওনা নিয়ে আলোচনা করা উচিত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে কিছু শিল্পে বিদেশি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। অস্ত্র, গোলাবারুদ ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম; সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বনায়ন এবং যান্ত্রিকভাবে বনসম্পদ আহরণ; পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন এবং টাকা মুদ্রণ, এ চারটি ক্ষেত্র সরকারি বিনিয়োগের জন্য সংরক্ষিত।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে জ্বালানি তেল বিপণন এবং গ্যাস বিতরণে পুরোপুরি বিদেশি মালিকানার অনুমতি দেয় না বাংলাদেশ। এ ছাড়া টেলিযোগাযোগে বিদেশি মালিকানা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

শতভাগ মালিকানা হবে নাকি হবে না, সেটি পরের কথা এটি একটি দেশের সুবিধা অনুযায়ী দেবে, এভাবে চাপিয়ে দেয় নাকি? প্রথমে দেখতে হবে জাতীয় সক্ষমতা, তারপর জাতীয় প্রতিষ্ঠান, এরপর দেশীয় প্রতিষ্ঠান, এর পর আসতে পারে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিষয়। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ পেলে দেশে একটি অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চাপের মুখে থাকতে হবে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে কৌশলগত ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম মিডিয়াকে বলেন, বিদেশি কোম্পানিকে অনুমতি দিলে বাংলাদেশকেও বেসরকারিভাবে তেল আমদানি করতে দিতে হবে। এখন তো সব ধরনের জ্বালানি তেল সরকারিভাবে আমদানি হয়। আর বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকেও একই সুবিধা দিতে হবে।

দেশের লাভক্ষতি নিয়ে তিনি বলেন, একটি নিয়মনীতির মাধ্যমে তেল আমদানি বেসরকারি খাতে দিতে পারে। এতে সমস্যা দেখি না, নিরাপত্তার ঝুঁকিও নেই। বেসরকারি খাত এখানে এলে প্রতিযোগিতা হবে। তবে এর জন্য পর্যাপ্ত নিয়মনীতি থাকতে হবে।

বর্তমানে দেশের ১৭ খাতে ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিদেশিদের মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। এগুলো হলো– বিমান চলাচল; ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান; কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং খনিজ অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং সরবরাহ; অপরিশোধিত তেল পরিশোধন; গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা; বীমা কোম্পানি; বৃহৎ পরিসরে অবকাঠামো প্রকল্প; বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ এবং বিতরণ; স্যাটেলাইট চ্যানেল; সমুদ্রবন্দর এবং ভিওআইপি ও আইপি টেলিফোন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বৈষম্য বড় আকারে না হলেও সরকার সাধারণত স্থানীয় শিল্পগুলোকে সমর্থন করে। আমদানি ওষুধের অনুমোদন নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যদি তারা দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। নতুন শিপিং এবং বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকানা থাকা আবশ্যক। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রায়ই স্থানীয় অংশীদার থাকা প্রয়োজন, যদিও এই প্রয়োজনীয়তা আইনিভাবে সংজ্ঞায়িত করা নেই।

এদিকে তেল, গ্যাস, টেলিযোগাযোগ ও বীমার ক্ষেত্রে মার্কিন বিনিয়োগের বাধা দূর করার পাশাপাশি মার্কিন যেসব বিনিয়োগ বাংলাদেশে রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুত প্রত্যাবাসনের শর্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পুরো বিশ্বে অস্থিরতা তৈরি হয়। সে সময় তীব্র ডলার সংকটে পড়ে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে মার্কিন জ্বালানি খাতের কোম্পানি শেভরন, বীমা প্রতিষ্ঠান মেটলাইফ, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, কোমল পানীয় প্রতিষ্ঠান কোকাকোলা, বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিটি ব্যাংক এনএ, মাস্টারকার্ড, জেনারেল ইলেকট্রনিক্সসহ (জিই) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে। বিগত সরকার ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ আটকে যাওয়ার বিষয়টিতে একাধিকবার উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ডলার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে ২০১৯ সালের পর থেকে মেটলাইফ যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মুনাফার অর্থ পাঠাতে পারেনি। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ এ দেশে আটকে আছে। একইভাবে শেভরনও দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছ থেকে তাদের পাওনা বুঝে পাচ্ছে না।

বাংলাদেশে থাকা মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থের প্রত্যাবাসন সংকট নিয়ে জানতে চাইলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, সরকার ইতোমধ্যে শেভরনের বকেয়া পরিশোধ করেছে। আর অন্য বিনিয়োগকারীদের নিজ অর্থ নিয়ে যাওয়া অনুমোদন দিয়েছে।

বিনিয়োগে মালিকানার সীমা উন্মুক্ত, আটকে থাকা অর্থ প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের যেখানে ‘অনাপত্তি সনদ’ প্রয়োজন, সেখানে সরকারকে এটি ব্যবস্থা করে দেওয়ার শর্ত দিয়েছে ওয়াশিংটন। পাশাপাশি মার্কিন বিনিয়োগকারীর মূলধন মুক্তভাবে প্রচলিত মুদ্রার বাজারমূল্যে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ স্বচ্ছতা আনবে ও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দক্ষতা আনার শর্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য একটি পরিষ্কার নির্দেশিকা থাকবে। একই সঙ্গে কত দিনের মধ্যে মূলধন প্রত্যাবাসনের অনুমোদন সরকার দেবে, তার সময়সীমা থাকতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top